মেহেরগড় সভ্যতা (৭০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ- ৩২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ):


মূলত বালুচিস্তানের ঝোব্ নদী থেকে পশ্চিম ভারতের সিন্ধু নদ পর্যন্ত অঞ্চলের মধ্যস্থিত প্রায় ৫০০ একর স্থান জুড়ে গড়ে উঠেছিল এই মেহেরগড় সভ্যতা। বোলান গিরিপথ এর কাছে এবং কোয়েটা শহর থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরত্বে কাচ্চি সমভূমিতে মেহেরগড় সভ্যতার প্রত্নক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে।


মেহেরগড় সভ্যতার আবিষ্কারক
ফরাসি প্রত্নতাত্ত্বিক জেন ফ্রাঁসোয়া জারিজ ও রিচার্ড মিডৌ ১৯৭৪ সালে এই সভ্যার আবিষ্কার করেন। (রেডিও কার্বন-১৪ পদ্ধতি দ্বারা পরীক্ষিত)।

মেহেরগড় সভ্যতার সময়কাল
প্রাগৈতিহাসিক যুগে ৭০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৩২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত এই সভ্যতার প্রমাণ পাওয়া যায়। মেহেরগড় সভ্যতাকে মূলত সাতটি স্তরে ভাগ করা যায় তার মধ্যে প্রথম তিনটি স্তর ছিল নব্য প্রস্তর যুগে। পরবর্তী স্তরগুলোতে ধাতুর যুগের সূচনা হয়।

মেহেরগড় সভ্যতার পরিসীমা
পূর্বে হিমালয় পর্বত ও থর মরুভূমি। পশ্চিমে ইরাক, ইরান, ভূমধ্যসাগর, আরবের মরুভূমি। উত্তরে বলকান, এলবুজ, হিন্দুকুশ, ককেশাস প্রভুজি ইউরো-এশিয়াটিক পর্বতমালা। দক্ষিনে মহেঞ্জোদাড়ো ও কর্কটক্রান্তি রেখার মধ্যবর্তী অঞ্চল।

মেহেরগড় সভ্যতার প্রাচীনত্ব
প্রাচীনত্ব নির্ধারণের অত্যাধুনিক রেডিও কার্বন ১৪ পদ্ধতি, বিভিন্ন সাক্ষ্য-প্রমাণাদি ও পুরাতাত্ত্বিক গবেষণালব্ধ তথ্য জানা গেছে যে, এই সভ্যতার মোট সাতটি পর্ব যার মধ্যে প্রথম তিনটি পর্ব নতুন প্রস্তর যুগের সমসাময়িক। তবে এর নগরায়নের পরিণত রূপটি পরিলক্ষিত হয় খ্রিস্টপূর্ব ৩২০০-২৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। আনুমানিক ২৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এই সভ্যতা মানবশূন্য হয়ে পড়ে।

মেহেরগড় সভ্যতার সভ্যতার বিভিন্ন কেন্দ্র সমূহ

মেহেরগড়, কিলেগুল মহম্মদ, রানা ঘুনডাই, গুমলা, আনজিরা মুন্ডিগাবা, কোটদিজি, পেরিয়ানো ঘুনডাই, কুল্লিমেহি, ডাম্বসাদৎ প্রভৃতি উল্লেখ্য।

মেহেরগড় সভ্যতার বৈশিষ্ট্য

  • মেহেরগড় সভ্যতার সাতটি স্তর থেকেই জানা যায় সেখানকার মানুষের পশুপালনের জীবন থেকে শুরু করে নাগরিকতায় উত্তরণের প্রতিটা অধ্যায়ের কথা।
  • এই সভ্যতার প্রথম পর্যায় মানুষ ভ্রাম্যমাণ পশুপালক কিংবা শিকারি জীবন পালন করলেও পরবর্তীতে কৃষিভিত্তিক জীবন যাপন শুরু করে এবং স্থায়ী বাসস্থান গড়ে তোলে।
  • মেহেরগড় সভ্যতা ছিল কৃষিকেন্দ্রিক গ্রামীণ সভ্যতা। প্রথম থেকে নানা প্রজাতির বার্লি যব গম চাষ করতো এখানকার মানুষেরা। পরবর্তীতে কার্পাস চাষের প্রমাণ পাওয়া যায়।
  • এর দ্বারাই প্রমাণিত হয় হরপ্পা সভ্যতার ২০০০ বছর আগেও এখানে তুলো চাষ শুরু হয়েছিল।
  • সেচ ব্যবস্থার প্রচলন ছিল এই সময়।
  • গৃহপালিত পশুদের মধ্যে গরু, ভেড়া, ছাগলের অস্তিত্ব প্রমাণ করা যায় এবং মনে করা হয় কুকুরও এইসময়ে মানুষের পোষ মেনেছিল।
  • প্রথম পর্যায়ে মৃৎশিল্পের ধারনা না থাকলেও পরবর্তীতে অভাবনীয় উন্নতি লক্ষ্য করা যায়। এমনকি কুমোরের চাকার ব্যবহার দেখা যায়।
  • মৃত দেহকে সমাধি দেয়ার প্রচলন ছিল মৃতদেহগুলোকে একপাশে কাত করে হাঁটু মুড়ে সমাধিস্থ করা হতো এবং সমাধির পাশে রেখে দেওয়া হতো ঝিনুক জাতীয় লকেট পাথরের পুঁতি প্রভৃতি।
  • তামার আবিষ্কার এবং প্রয়োগ এই যুগের উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
  • বিভিন্ন সিলমোহর কিংবা পোড়ামাটির নারীমূর্তি পাওয়া গেছে যেগুলি হরপ্পা সভ্যতায় প্রাপ্ত নারী মূর্তি ও সিলমোহরের পূর্ব নিদর্শন বলে মনে করা হয়।
  • এখানকার মানুষ দামি পাথরের মালা (কর্নেলিয়াস), টারকোয়েজ, লাপিস লাজুলি ঝিনুকের মালা ব্যবহার করত।
  • পাথর এবং ধাতু উভয়টি তৈরি বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া গেছে এই অঞ্চল থেকে।

মেহেরগড় সভ্যতার পতন
বিভিন্ন ঐতিহাসিকেরা বিভিন্ন কারণ ব্যাখ্যা করেছে মেহেরগড় সভ্যতার পতনের কারণরূপে। 
যেমন: জলবায়ুর পরিবর্তন, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, বাসভূমির পরিবর্তন এবং বহিঃশত্রুর আক্রমণ।

মেহেরগড় সভ্যতার গুরুত্ব
মেহেরগড় সভ্যতার আবিষ্কারের গুরুত্ব অনেক। এই সভ্যতার আবিষ্কারের ফলে ভারতীয় সভ্যতা এবং তার পরিপ্রেক্ষিতটিই সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়ে গেছে।
মেহেরগড় সভ্যতা আবিষ্কারের আগে মনে করা হতো সিন্ধু সভ্যতায় ভারতের প্রাচীনতম সভ্যতা। কিন্তু এর আবিষ্কার প্রমাণ করে সিন্ধু পূর্ব যুগে ভারতে একটি উন্নত সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল। এছাড়াও আগে মনে করা হতো যে হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো ছিল মেসোপটেমিয়ার দূরবর্তী কোন উপনিবেশ। কিন্তু পরবর্তীতে মেহেরগড় সভ্যতা আবিষ্কারের ফলে আগের ধারণার বক্তব্যে কুঠারাঘাত করা গেছে। এবং হরপ্পা সভ্যতার মানুষ যে বহিরাগত নয়, তারা ভারতেরই মানুষ তাও মেহেরগড় সভ্যতা আবিষ্কারের ফলেই প্রমাণিত হয়েছে।

ভীমবেটকা গুহা
ভীমবেটকা হল ইউনেস্কো স্বীকৃতি একটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ স্থান। এটি মধ্যপ্রদেশের রাজধানী ভূপালের থেকে ৪৫ কিমি দক্ষিণে বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিণ প্রান্তে রাইসেন জেলায় অবস্থিত। এটি প্রায় এক লক্ষ বছর আগে পুরা প্রস্তর যুগের (প্যালিওলিথিক) মানুষের বসবাসের জায়গা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এই স্থানে গুহাচিত্র দেখতে পাওয়া যায়। প্রথমে এটি বৌদ্ধ স্থান হিসেবে মনে করা হলেও পরে এটি পুরা প্রস্তরীয় স্থান হিসেবে আবিষ্কার করেন ভারতীয় গুহাচিত্রের জনক ওয়াকাঙ্কর। এটিকে ইউনেস্কো স্বীকৃতি দেয় ২০০৩ সালে।

প্রাগৈতিহাসিক যুগের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য

  • ভিমবেটকা: প্রথম হোমো সেপিয়েন্স এর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। প্রস্তর শিলালিপি, গুহা ও চিত্রকলারও নিদর্শন পাওয়া যায় এখানে।
  • নেভাসা: সুতির বস্ত্র ব্যবহারের নিদর্শন পাওয়া যায়।
  • অত্রণোজিখেদা: পোশাকে চিত্র অংকন করার রীতি পরিলক্ষিত হয় এই স্থানে।
  • হস্তিনাপুর: আখ চাষের নিদর্শন পাওয়া যায়।
  • ইনামগাঁও: মাতৃদেবীর মূর্তি পাওয়া যায়।
  • মেহেরগড়: প্রাচীনযুগে কৃষিকার্যের নিদর্শন মেলে।
  • কোলদিভা: সর্বপ্রথম ধান চাষের নিদর্শন পাওয়া যায়।
  • বাগর ও আদমগড়: প্রথম পশুপালনের নিদর্শন পাওয়া যায়।

মেহেরগড় সভ্যতা সম্পর্কিত তথ্য সমূহ
  • মেহেরগড় সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ সম্পর্কিত প্রথম গবেষণা নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়— 'সাইন্টিফিক আমেরিকান' পত্রিকায় (১৯৮০ খ্রিস্টাব্দ)।
  • ঐতিহাসিকগণ আর্য আক্রমণ তত্ত্বকে নস্যাৎ করে মেহেরগড় থেকে ভারতীয় সভ্যতার পৌনঃপুনিক বিবর্তনের ধারাকে স্বীকার করে নিয়েছেন – ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে ডিসেম্বরে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব-প্রত্নতাত্ত্বিক সম্মেলনে।
  • মেহেরগড়, হরপ্পা ও বৈদিক সভ্যতাকে একত্রে 'সিন্ধু সরস্বতী সভ্যতা' আখ্যা দিয়ে এক অবিভাজ্য
  • সভ্যতার বিভিন্ন পর্ব রূপে চিত্রায়িত করেছেন – মার্কিন ভারততত্ত্ববিদ ডেভিড ফ্রলে।
  • মেহেরগড়ের পশ্চিম দিকের উর্বর অঞ্চলকে আধুনিক পণ্ডিতদের নামকরণ করেছেন-'উর্বর হাঁসুলী' (Fertile Crescent).
  • ঐতিহাসিক সেরিন রত্নাগার মনে করেন যে, মেহেরগড় মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল ইরান আফগানিস্তান ও তুর্কমেনিস্তান।
  • ঐতিহাসিক সেরিন রত্নাকরের মত অনুসারে মেহেরগড়ের অধিবাসীরা যে বিষয়ে অবগত ছিল তা হলো-সুতিবয়ন বিদ্যা।
  • মেহেরগড় সম্পর্কে খুঁটিনাটি তথ্য জানা যায় ব্রিজেট অলজিন ও রেমন্ড অলচিনের লেখা Barth of Indian civilization 4 the rise of civilization in India and Pakistan in (1986).
  • মেহেরগড়ের মৃৎশিল্পের সঙ্গে ইরানের শিয়ালক শৈলীর এবং দক্ষিণ তুর্কমেনিস্তানের নমাজগায় প্রাপ্ত মৃৎপাত্রগুলির সাদৃশ্য রয়েছে।
  • এখানকার মানুষ দামি পাথরের (কর্নেলিয়াস) মালা, টারকোয়েজ, লাপিস লাজুলি, ঝিনুকের মালা বানিয়েছিল।
  • মেহেরগড়ে ভারতীয় উপমহাদেশের স্থায়ী কৃষি কার্যের প্রাচীনতম সাক্ষ্য মিলেছে।
  • এখানকার মানুষ তামার আয়নার ব্যবহার শিখেছিল, তবে তার নজির খুব কম, এটি ছিল সৌখিনদ্রব্য।

  • মেহেরগড়বাসীদের পতনের কারণ রূপে ঐতিহাসিকরা,
১) জলবায়ু পরিবর্তন।
২) প্রাকৃতিক বিপর্যয়।
৩) বাসভূমির পরিবর্তন।
৪) বহিঃশত্রুর আক্রমণকে দায়ী করেছেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন for "মেহেরগড় সভ্যতা (৭০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ- ৩২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ):"