রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা: রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্পর্কে মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গী: (Political Science).
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা?
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি নির্দিষ্ট সংজ্ঞা দেওয়া কষ্টকর ব্যাপার, কারণ এটি একটি গতিশীল বিজ্ঞান। বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা দিয়েছেন।যেমন:-
- গার্নার মতে, 'রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শুরু ও সমাপ্তি রাষ্ট্রকে নিয়ে'।
- ফরাসী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী পল জানেটের মতে, 'রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল সমাজবিজ্ঞানের সেই অংশ, যার আলোচ্য বিষয় রাষ্ট্রের ভিত্তি ও সরকারের নীতিসমূহ'।
- আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হ্যারল্ড ল্যাস্কির মতে, 'রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল সংগঠিত রাষ্ট্রের পরিপ্রেক্ষিতে মানবজীবনের আলোচনা'।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বলতে কি বোঝায়?
সমাজবিজ্ঞানের একটি শাখা হিসাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞান, বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনার সাহায্যে রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের তত্ত্ব, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, আন্তর্জাতিক আইন, রাজনৈতিক কার্যকলাপ, ক্ষমতা, বিরোধ ও বিরোধের মীমাংসা, ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত আচার-আচরণ, রাজনৈতিক কাজে অংশগ্রহণ ও রাজনৈতিক পরিবর্তন ইত্যাদিকে বোঝায়।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা?
সমাজ সতত পরিবর্তনশীল তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা নির্দেশ করা আজও সম্ভব হয়নি। বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্পর্কে বিভিন্ন ধ্যান-ধারণা গড়েওঠে ও সেগুলি পরিবর্তিত হতে দেখা যায়। এ সম্পর্কে ওয়াসবী'র ধারণা, 'রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিবর্তনশীল চরিত্র এবং অনির্দিষ্ট বিষয়বস্তু সম্পর্কে বিভ্রান্তি ও মতপার্থক্যের জন্যই কোন একটি সংজ্ঞাকে নির্ভুল বলে গ্রহণ করা সম্ভব নয়'।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কি কোনো গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা আছে?
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কোনো সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা নেই। তবে বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর প্রদত্ত সংজ্ঞাগুলি থেকে একটি গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা দেওয়া যেতে পারে। 'রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল সমাজবিজ্ঞানের সেই শাখা যা রাষ্ট্রের তত্ত্ব, সংগঠন, শাসনব্যবস্থা,আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, রাজনৈতিক দল ও স্বার্থগোষ্ঠীর কার্যাবলী, রাজনৈতিক ক্ষমতা, রাজনৈতিক মনোভাব, আদর্শ, প্রভাব ও সামাজিক ভোট প্রদানকারীদের আচরণের বিচার বিশ্লেষণ করে'।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান কি বিজ্ঞান?
বিজ্ঞান হ'ল কোনো বিষয় সম্পর্কে সু-সংবদ্ধ জ্ঞান। যা অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের সাহায্যে অর্জিত হয়। এই অর্থে রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে 'বিজ্ঞান' বলা যায়। তবে ব্রাইসের মতানুসারে এই শাস্ত্রকে আবহবিজ্ঞানের মত ‘অসম্পূর্ণ বিজ্ঞান' বলাই সঙ্গত।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্পর্কে মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গী?
মার্কসবাদীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কোন নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নির্দেশ করেননি। মার্কস ও এঙ্গেলসের মতে, রাজনীতি হ'ল সামাজিক প্রক্রিয়ার অন্যতম দিক। কোনো সমাজের অর্থব্যবস্থা, শ্রেণী সম্পর্কের রূপ সেই সমাজের রাজনীতিকে প্রকাশ করে। তাই মার্কসবাদীদের মতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাই হ'ল রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। অর্থাৎ শ্ৰেণী সংগ্রাম, শ্রেণী আধিপত্য ও শ্রেণী প্রভূত্বই হ'ল রাজনীতির মূলকথা। লেনিনের মতে, বিভিন্ন শ্রেণীর সঙ্গে রাষ্ট্র ও সরকারের সম্পর্ক এবং বিভিন্ন শ্রেণীর আভ্যন্তরীণ পারস্পরিক সম্পর্কই হল রাজনীতি।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলোচনার পদ্ধতিগুলি:
রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলোচনার পদ্ধতিগুলি হ'ল-
(ক) ঐতিহাসিক পদ্ধতি।
(খ) পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি।
(গ) পরীক্ষণমূলক পদ্ধতি।
(ঘ) দার্শনিক পদ্ধতি।
(ঙ) তুলনামূলক পদ্ধতি।
(চ) আইনমূলক পদ্ধতি।
(ছ) আচরণবাদী পদ্ধতি ইত্যাদি।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়:
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়সূচীর সীমানা নির্ধারণের প্রয়াস কষ্টকর ব্যাপার। তবে কতকগুলি বিষয়কে চিহ্নিত করা যায়, যেমন- (ক) রাষ্ট্র (খ) রাষ্ট্রীয় তত্ত্ব (গ) সরকার (ঘ) নাগরিকের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক (ঙ) জনমত (চ) নির্বাচক মণ্ডলী (ছ) রাজনৈতিক দল (জ) চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী (ঝ) আন্তর্জাতিক সংগঠন (ঞ) আন্তর্জাতিক আইন (ট) বিভিন্ন রাষ্ট্রীয়ব্যবস্থার তুলনামূলক আলোচনা ইত্যাদি।
ইউনেস্কো (UNESCO) নির্ধারিত রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়:
১৯৪৮ সালে UNESCO নির্ধারিত রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়গুলি হ'ল-
- (ক) রাজনৈতিক তত্ত্ব ও তার ইতিহাস।
- (খ) রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ।
- (গ) রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠী, জনমত, নাগরিক অধিকার ও কর্তব্য।
- (ঘ) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, আন্তর্জাতিক আইন ও সংগঠন ইত্যাদি।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান কি গতিশীল বিজ্ঞান?
মানুষের সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার পরিধিও পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত হয়েছে। তাই অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের ন্যায় রাষ্ট্রবিজ্ঞাকেও একটি 'গতিশীল বিজ্ঞান' বলা যায়।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান বলার বিপক্ষে যুক্তি:
- রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয় হল মানুষ ও মানবসমাজ, যা দেশ-কাল ভেদে পরিবর্তিত হয়, কিন্তু বিজ্ঞানের বিষয়গুলি দেশ-কাল ভেদে একই প্রকৃতির থাকে।
- রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়কে বিভক্ত করে পরীক্ষা করা সম্ভব নয় এবং পৃথক পৃথক ভাবে ব্যক্তিকে নিয়ে বিশ্লেষণও সম্ভব নয়, কিন্তু পদার্থ বিজ্ঞানের বিষয়গুলিকে এমনকি অণু-পরমাণুতে বিভক্ত করে বিশ্লেষণ করা হয়।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান বলার পক্ষপাতী কারা?
অ্যারিস্টটল, মন্তেঙ্কু, ব্রাইস, ক্যাটলিন, বোঁদা, হবস প্রমূখ দার্শনিক ও আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে 'বিজ্ঞান' বলে মনে করেন।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান বলার বিপক্ষে কারা?
কোঁৎ, মেটল্যাণ্ড, বাক্ প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে ‘বিজ্ঞান' বলতে রাজী নন।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন for "রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা: রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্পর্কে মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গী: (Political Science)."