প্রস্তর যুগ ও তামার যুগ: (Stone Age and Copper Age).


পৃথিবীতে মানুষের প্রথম আবির্ভাব ঘটে ৪.২ মিলিয়ন বছর পূর্বে আফ্রিকার মাটিতে। বর্তমানের আধুনিক মানুষ বা Homo Sapiens এর উৎপত্তি হয় মাত্র ৫০০০০ বছর পূর্বে। ভারতে প্রথম মানুষের আবির্ভাব খ্রীঃ পূঃ ২ থেকে ৩ লক্ষ বছর আগে। ভারতের মধ্যে শিবালিক পার্বত্য অঞ্চলেই প্রথম ১০-১৪ মিলিয়ন বছর পূর্বের মনুষ্য জাতীয় প্রাণীর ফসিল আবিষ্কৃত হয়।

উদাহরণ:
  • রামাপিথেকাস (Ramapithecus) (পুরুষ)।
  • শিবপিথেকাস (Shivapithecus) (মহিলা)।

এছাড়া নর্মাদা উপত্যাকার হাতনোড়াতে (Hathnora) ১.৪ মিলিয়ন বৎসর পূর্বের Homo erectus গোত্রের মানুষের ফসিল পাওয়া গেছে।

মানুষের সৃষ্টির পর থেকে বর্তমানের সভ্য মানুষের বিবর্তনের সময়কালকে ২টি ভাগে ভাগ করা হয়।
যথা:
প্রস্তর যুগ।
ধাতুর যুগ।


প্রস্তর যুগ তিন ভাগে বিভক্ত:
যথা:

  • প্রাচীন প্রস্তর যুগ (Palaeolithic age). (upto ৯০০০ BC).
  • মধ্য প্রস্তর যুগ (Mesolithic age). (৯০০০-৪০০০ BC).
  • নব্য প্রস্তর যুগ (Neolithic age). (৪০০০-১৮০০ BC).

প্রাচীন প্রস্তর যুগ তিন ভাগে বিভক্ত:
যথা:
  • মধ্য প্রত্ন প্রস্তর যুগ (Lower Palaeolithic age).
  • মধ্য প্রত্ন প্রস্তর যুগ (Middle Palaeolithic age).
  • উচ্চ প্রত্ন প্রস্তর যুগ (Upper Palaeolithic age).

প্রাচীন প্রস্তর যুগ (Palaeolithic Age):

'Palaeolithic' শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন জন লুবক (John Lubbock)। এই সময় অস্ত্রশস্ত্র তৈরী হত কোয়ার্জাইট পাথর (Quartzite stone) দ্বারা, তাই প্রত্ন প্রস্তর যুগের মানুষকে কোয়ার্জাইট মানুষও (Quartzite man) বলা হয়।

রবার্ট ব্রুসফুট (Robert Brucefoot) ভারতে প্রথম প্রস্তর যুগের পাথরের হাতিয়ার আবিষ্কার করেন, চেন্নাইয়ের কাছে আত্তিরামপক্কম থেকে। 
প্রাচীন প্রস্তর যুগের মুখ্য হাতিয়ারগুলি হল— Scrapper. Handaxe and Chopper.

প্রাচীন প্রত্ন প্রস্তর যুগ (Lower Palaeolithic age):

প্রাচীন প্রস্তর যুগের অস্ত্রগুলি হল— হস্ত কুঠার (Hand axe), কাটারী (Chopper), চাছনি (Cleaners)।

প্রাচীন প্রস্তর যুগের আবিষ্কৃত স্থান— বেলান উপত্যকা (মধ্যপ্রদেশ), ভীমবেটকা (মধ্যপ্রদেশ), সিংভূম (ঝাড়খণ্ড), উত্তর-পশ্চিম পাঞ্জাব অঞ্চলের শোন নদীর দ্বারা বিভক্ত পটওয়ার মালভূমি। বেলান উপত্যকায় Paleolithic Mesolithic ও Neolithic পরপর পর্যায়ে পাওয়া যায়।

মধ্য প্রত্ন প্রস্তর যুগ (Middle Palaeolithic age):

মধ্য প্রত্ন প্রস্তর যুগের অস্ত্র— শল্ক পাথরের তৈরী অস্ত্র। চাঁছনি (Scrappers), তীক্ষ্ণাগ্র (Pointer's), ছেদনি (Blade), খোদনাস্ত্র (Boarer) 

মধ্য প্রত্ন প্রস্তর যুগের আবিষ্কৃত স্থান— শোন, নর্মদা ও তুঙ্গভদ্রা উপত্যকায় মূলত দেখা যায়।

উচ্চ প্রত্ন প্রস্তর যুগে (Upper Palaeolithic age):

আধুনিক মানুষ (Homo sapiens) এর উদ্ভব হয় এই যুগেই।

উচ্চ প্রত্ন প্রস্তর যুগের অস্ত্র— এই সময়ে ছুরি, চাঁছনি (scrappers), খোদনযন্ত্র (Boarer) এবং অস্থিনির্মিত অস্ত্র দেখা যায়।

উচ্চ প্রত্ন প্রস্তর যুগের আবিষ্কৃত স্থান— সোহান উপত্যকা (পশ্চিম পাঞ্জাব), বেলান উপত্যকা (মধ্যপ্রদেশ), অত্তিরামপক্কম (তামিলনাড়ু)। বেলান উপত্যকায় হাড়ের তৈরি Mother Godess-এর মূর্তি পাওয়া যায়।

মধ্যপ্রস্তর যুগ (Mesolithic age):

এই যুগকে ক্ষুদ্রাস্ত্র যুগ হিসাবেও চিহ্নিত করা হয়।

ক্ষুদ্রাস্ত্র (Microliths)— ছোট পাথরের তৈরী তীক্ষ্ণ ও ধারাল অস্ত্র। কার্লাইল (Carlyle) বিন্ধ্য পর্বতের গুহার মধ্যে প্রথম ক্ষুদ্রাস্ত্র (ভারতের মধ্যে) আবিষ্কার করেন। যুগে বর্শাফলক, ক্ষুদ্রাস্ত্র ও কর্তনী দেখা যায়।

মধ্যপ্রস্তর যুগের গৃহপালিত পশু— রাজস্থানের বাগর (Bagor) এবং মধ্যপ্রদেশের আদমগ্রাম (Adamgram)-এ গরু, ভেড়ার মত প্রাণীকে গৃহপালিত করার প্রচেষ্টা দেখা যায় এই যুগেই।

মধ্যপ্রস্তর যুগের আবিষ্কৃত স্থান— পাঁচমারি, ভীমবেটকা (মধ্যপ্রদেশ) পাথরের গুহাচিত্র পাওয়া গেছে, লংঘা (Langhanj) (গুজরাত)।

নব্য প্রস্তর যুগ (Neolithic age):

তাই যুগে মানুষ শিকার ও খাদ্য সংগ্রাহকের পরিবর্তে খাদ্য উৎপাদক হয়ে ওঠে। স্যার জন লুবক প্রথম নব্য প্রস্তর কথাটি উচ্চারণ করেন।

নব্য প্রস্তর যুগের মূল বৈশিষ্ট্য:

  • পালিশ করা অত্যন্ত ধারালো পাথরের অস্ত্র।
  • কৃষিকাজের সূত্রপাত।
  • চাকা আবিষ্কার।
  • আগুনের ব্যাপক ব্যবহার।
  • ব্যাপকভাবে পশুপালন।

গর্ডন চাইল্ড এই যুগকে 'Neolithic Revolution' বলেছেন। 
এই যুগে মাটির বাসন তৈরীর কাজ শুরু হয়। এগুলিকে পোড়ানো হত এবং কালো ও লাল রঙে রাঙানো হত।

নব্য প্রস্তর যুগের উল্লেখযোগ্য সভ্যতা হল— মেহেড়গড় সভ্যতা (৭০০০ খ্রীষ্টপূর্ব)। বালুচিস্তানের (বোলান গিরিপথে) যার ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। এখানে কৃষিকাজের প্রথম সূত্রপাত হয়। ৩০০টি পরিবার বা বাড়ি নিয়ে এই প্রামা সভ্যতা গড়ে উঠেছিল।

নব্য প্রস্তর যুগের উল্লেখযোগ্য স্থান— 
  • বুরজাহোম (Burzahom), গাফ করাল (Gufkaral) – কাশ্মীর। দাওজালি হাডিং (Doojali hudding) আসাম।
  • নব্যপ্রস্তর যুগের নিদর্শন ভারতে প্রথম আবিষ্কার করেন লে মুশিয়ের (Le Mesurier) নব্যপ্রস্তর যুগের কৃষিকার্যের অস্তিত্ব প্রথম খুঁজে পাওয়া গেছে নাল (Nal) নামক স্থানে।
  • ভারতে নব্য প্রস্তর যুগের প্রথম আবিষ্কৃত স্থান- লিঙ্গারুর (Lingarur)।
  • বুরজাহোম বিখ্যাত ছিল কূপঘর (Pit dwelling) এর জন্য। এখানেই কুকুরের সাথে মানুষের সমাধি পাওয়া গেছে)।
  • House burials were found form Uleri in Almora. সেনোয়ার (Senwuar) - বিহার। নব্যপ্রস্তর যুগের হাড়ের অস্ত্র পাওয়া গেছে। 
  • Koldiha অঞ্চলে ধান চাষের অস্তিত্ব পাওয়া যায় এবং উচ্চ-মধ্য-নব্য তিনটি প্রত্নস্তরের হদিশ পাওয়া যায়।
  • চোপ্ৰনিমান্ড নামক স্থানে পৃথিবীর প্রথম বাসনপত্র তৈরির নিদর্শন পাওয়া যায়।
  • ভারতের বিন্ধ্য পর্বতের উত্তরাংশ এবং নর্মদা উপত্যকার বেলান উপত্যকায় প্রাচীন, মধ্য ও নব্যপ্রস্তর—এই তিন সংস্কৃতির নিদর্শন পাওয়া গেছে।

বৃহৎ প্রস্তর সংস্কৃতি (Megalithic Culture):

নব্য প্রস্তর যুগে মৃতদেহ সমাহিত করার পর অনেক সময় বৃহৎ আকৃতির প্রস্তর খণ্ড দ্বারা সমাধি ক্ষেত্র তৈরী করা হত। এগুলি বিভিন্ন নামে পরিচিত,
যথা: মেনহির (Menhirs), ডলমেন (Dolmens)।

ধাতুর যুগ:

তাম্র প্রস্তর যুগ (Chalcolithic age): ১৮০০-১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।
লৌহযুগ (Iron age): ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে আজ পর্যন্ত।

তাম্র প্রস্তর যুগের মূল বৈশিষ্ট্য:

  • পাথরের সাথে সাথে তামা ও ব্রোঞ্জের ব্যাপক ব্যবহার।
  • ঝুম চাষের সূত্রপাত।
  • রঙিন মৃৎপাত্রের ব্যবহার।

তাম্র প্রস্তর যুগের আবিষ্কৃত স্থান— 
  • আহর (Ahar) (রাজস্থান), দৈমাবাদ (Daimabad) (মহারাষ্ট্র) ইত্যাদি স্থানে এই যুগের নিদর্শন পাওয়া গেছে।
  • মালব (Malab) (গুজরাত) বৃহত্তম তাম্র প্রস্তর সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া গেছে। সব থেকে বেশি তাম্র প্রস্তর যুগের সভ্যতা আবিষ্কৃত হয়েছে চম্বল নদী উপত্যকায়।

  • মধ্য প্রস্তর সংস্কৃতির যে স্থানটি সম্পূর্ণভাবে আবিষ্কৃত হয়েছ তা হল বাগর (Bagar) রাজস্থান।

মধ্য প্রস্তর যুগে হরিণের ছবি সব থেকে বেশি অঙ্কিত হয়েছিল।

ধান চাষ ছিল পূর্ব ভারতে নব্য প্রস্তর যুগের মূল বৈশিষ্ট্য।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন for "প্রস্তর যুগ ও তামার যুগ: (Stone Age and Copper Age)."