মহাবীর ও জৈনধর্মের ইতিহাস: (History of Mahabir and Jainism).


জৈনধর্ম প্রাচীন ভারতে প্রবর্তিত অন্যতম ধর্মমত। এই ধর্মের মূল বক্তব্য হল সকল জীবের জন্য শান্তি ও অহিংসার পথ গ্রহণ। যে ব্যক্তি বা আত্মা অন্তরের শত্রুকে জয় করে সর্বোচ্চ অবস্থাপ্রাপ্ত হন তাঁকে 'জিন' (জিতেন্দ্রিয়) আখ্যা দেওয়া হয়। আর এই জিন কথা থেকেই জৈন কথাটি এসেছে।জৈন ধর্মের ইতিহাসে মোট ২৪ জন তীর্থঙ্কর রয়েছেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ২৩তম তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথ এবং ২৪তম তীর্থঙ্কর মহাবীর।


জৈন ধৰ্ম বৌদ্ধ ধর্ম অপেক্ষা অনেক প্রাচীন মনে করা হয়। প্রথম তীর্থঙ্কর ঋষভদেবের কথা ঋগ্বেদ এবং বায়ু পুরানে পাওয়া যায়। অরিষ্টনেমির নাম ঋগ্বেদে পাওয়া যায়।

মহাবীরের পরিচয়:
  • জন্ম: বৈশালী জেলার কুন্দ গ্রামে (৫৪০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)। বর্তমানে বিহারের মজাঃফরপুর জেলার বসার গ্রাম।
  • পিতা: সিদ্ধার্থ (জ্ঞাতৃক নামক ক্ষত্রিয় জাতির রাজা)।
  • মাতা: ত্রিশলা (লিচ্ছবি রাজ চেতকের ভগ্নি)।
  • স্ত্রী: যশোদা।
  • কন্যা: প্রিয়দর্শনা।
  • প্রথম শিষ্য: জামিলি বা জৈমিলি (জামাতা)।
  • পিতৃদত্ত নাম: বর্ধমান।

মহাবীর গৃহত্যাগ:
  • ৩০ বছর বয়সে পিতার মৃত্যুর পর তিনি সত্যের সন্ধানে আজবিক সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা গোশালার সাথে গৃহত্যাগ করেন।
  • ১৩ মাস ধরে নিরবিচ্ছিন্ন সাধনা ও তপস্যা করেন।
  • প্রথম দুবছর তিনি পার্শ্বনাথ প্রবর্তিত ধর্ম মতে একজন সদস্য নির্বাচিত হন।
  • পরে তিনি তা ত্যাগ করে দশ বছর দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে বেড়ান।
  • তিনি কঠোর তপস্যা করেন, শাল বৃক্ষের নিচে ধ্যান করেন এবং পোষাকপরিচ্ছদ সব পরিত্যাগ করেন।
  • ৪২ বছর বয়সে, জাম্বিকা গ্রামে ঋজুপালিকা নদীর তীরে জম্ভিকগ্রামে একটি শাল গাছের নিচে তিনি 'কৈবল্য' বা 'দিব্য জ্ঞান' (Supreme Knowledge) লাভ করেন।
  • জৈন ধর্মগ্রন্থ উত্তর-পুরাণ ও হরিবংশ-পুরাণ-এ এই ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়।
  • এই সময় থেকে তিনি মহাবীর (শ্রেষ্ঠ বীর), জিতেন্দ্রিয় (জিন অর্থাৎ রিপু জয়ী), নির্গন্থ (সংসার বন্ধন বিমুক্ত) নামে পরিচিত হন।
  • আচারাঙ্গ সূত্র মতে, মহাবীর ছিলেন সর্বদর্শী। সূত্রকৃতাঙ্গ গ্রন্থে 'সর্বজ্ঞতা' ধারণাটির ব্যাখ্যা এবং মহাবীরের অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলির বিবরণ পাওয়া যায়।

মহাবীরের ধর্মপ্রচার:
  • তিনি প্রথম ধর্মপ্রচার করেন পাবাতে ১১জন শিষ্যের কাছে যারা গান্ধার নাম পরিচিত ছিলেন।
  • এই ১১জন শিষ্যের মধ্যে একমাত্র সুধর্ম বেঁচে ছিলেন মহাবীরের মৃত্যুর পর।
  • এর পর তিনি প্রায় ৩০ বছর সারা ভারত পরিভ্রমণ করেন এবং নিজের দর্শন শিক্ষা দেন।
  • জৈন বিশ্বাস অনুসারে, মহাবীরের ১৪,০০০ সন্ন্যাসী, ৩৬,০০০ সন্ন্যাসিনী, ১৫৯,০০০ সেবক (গৃহস্থ ও ৩১৮,০০০ সেবিকা (গৃহস্থ নারী) অনুগামী ছিল।
  • তার অনুগামী রাজন্যবর্গের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন মগধের রাজা শ্রেণিকা (যিনি বিম্বিসার নামে পরিচিত ছিলেন), অঙ্গের রাজা কুণিক ও বিদেহের রাজা চেতক।

মহাবীরের মোক্ষ (নির্বাণ):
  • জৈনরা বিশ্বাস করেন, ৭২ বছর বয়সে মহাবীর মোক্ষ (জন্ম ও মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্তি) লাভ করেন এবং তার আত্মা এখন 'সিদ্ধশিলা'য় (মুক্ত আত্মাদের স্থান) অবস্থান করছে।
  • জৈন ধর্মগ্রন্থ অনুসারে, মহাবীর পাবাপুরীতে দেহত্যাগ করেন।
  • প্রবচনসার অনুসারে, মৃত্যুর পরে মহাবীরের শুধু নখ আর চুলই শুধু পড়ে থাকে। অবশিষ্ট শরীর কর্পূরের মতো হাওয়ায় বিলীন হয়ে যায়।
  • মহাবীর যেখানে মোক্ষ লাভ করেছিলেন বলে মনে করা হয়, সেখানে বর্তমানে জল মন্দির নামে একটি জৈন মন্দির রয়েছে।

জৈনধর্মের বিভাজন:
মহাবীরের মৃত্যুর পর চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের রাজত্বকালে গঙ্গা উপত্যকা থেকে দাক্ষিণাত্য পর্যন্ত এক ভয়ঙ্কর আকার এর দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। যেখানে তাদের ধর্মীয় মঠগুলি ছিল সেখান কার পুনর্বাসনের জন্য জৈনদের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি হয়। তখন থেকে জৈনদের মধ্যে দুটি বিভাগ সৃষ্টি হয় দিগম্বর ও শ্বেতাম্বর।

দিগম্বর কি?
ভদ্রবাহুর নেতৃত্বে যে সকল জৈন সন্ন্যাসী নগ্নতাকে গ্রহণ করেন অর্থাৎ বস্ত্রত্যাগের কথা দক্ষিণ ভারতে প্রচার করেন তাদের দিগম্বর বলে।

শ্বেতাম্বর কি?
স্থুলভদ্র এর নেতৃত্বে যেসকল জৈন সন্ন্যাসী শ্বেতবস্ত্র পরিধান কে গ্রহণ করে উত্তর ভারতে এই আদর্শ প্রচার করেন তাদের শ্বেতাম্বর বলে।

জৈনধর্ম চতুর্যাম:
২৩তম তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথ প্রবর্তিত জৈন ধর্মের চারটি নীতিকে চতুর্যাম বলা হয়। এই নীতিগুলি মহাবীর গ্রহণ করেছিলেন এগুলি হল-
  • অহিংসা (হিংসা না করা)।
  • সত্যবাদিতা (মিথ্যা না বলা)।
  • অচৌর্য (চুরি না করা)।
  • অপরিগ্রহ (কোন বস্তুর প্রতি মায়া বা শক্তি না থাকায় আসক্তি)।

পঞ্চমহাব্রত:
২৩তম তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথ প্রবর্তিত চতুর্যামের সাথে ব্রহ্মচর্য যুক্ত করি পঞ্চমহাব্রত প্রবর্তন করেন। যথা-
  • অহিংসা (হিংসা না করা)।
  • সত্যবাদিতা (মিথ্যা না বলা)।
  • অচৌর্য (চুরি না করা)।
  • অপরিগ্রহ (কোন বস্তুর প্রতি মায়া বা শক্তি না থাকায় আসক্তি)।
  • ব্রহ্মচর্য (সারা জীবন কৌমার্য পালন করা)।

জৈনধর্মের ত্রিরত্ন:
  • সম্যক শ্রদ্ধা বা বিশ্বাস (Right Faith)।
  • সম্যক জ্ঞান (Right Knowledge)।
  • সম্যক কর্ম (Right Action/Conduct)।

জৈনধর্ম সম্মেলন:

প্রথম সম্মেলন: তৃতীয় খ্রিস্টপূর্বাব্দের শুরুতেই স্থুলভদ্র এর সভাপতিত্বে পাটুলিপুত্র অনুষ্ঠিত হয়েছিল। শ্বেতাম্বর ও দিগম্বর দুটি সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়।

দ্বিতীয় সম্মেলন: পঞ্চম শতাব্দীতে দেবঋষিগানির নেতৃত্বে গুজরাটের বলভী তে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। জৈনদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ 'দ্বাদশ অঙ্গ' এর পুনর্মূল্যায়ন করে 'দ্বাদশ উপাঙ্গ' নামে আরও ১২ টি অনুশাসন যোগ করা হয়।

জৈনধর্মের স্থাপত্য বা ভাস্কর্য:
  • হাতিগুম্ফা, বাঘগুম্ফা, উদয়গিরি, খণ্ডগিরি (উড়িষ্যা)।
  • মাউন্ট আবুর দিলওয়ারা মন্দির, তেজপাল মন্দির গিরনার ও পালিটানা মন্দির (গুজরাত)।
  • পাবাপুরী ও রাজগৃহ মন্দির (বিহার)।
  • গোমতেশ্বর/বাহুবলী মূর্তি (শ্রাবণবেলগোলা) (মহীশূর/কর্ণাটক)।

জৈনধর্মের তীর্থঙ্করদের নাম ও প্রতীক

ক্রমিক সংখ্যা তীর্থঙ্কদের নাম প্রতীক
ঋষভদেব ষাঁড়
অজিত হাতি
সম্ভব ঘোড়া
অভিনন্দন বনমানুষ
সুমতি বক
পদ্মপ্রভা লাল পদ্ম
সুপার্শ্ব স্বস্তিকা
চন্দ্রপ্রভা চাঁদ
সুবিধি ডলফিন
১০ শীতলা বুক
১১ শ্রেয়মশা গণ্ডার
১২ বাসুপ্তজা মহিষ
১৩ বিমল বন্যশুকর
১৪ অনন্ত বাজপাখি
১৫ ধর্ম বজ্র
১৬ শান্তি কৃষ্ণসার মৃগ
১৭ ফগ্লু ছাগল
১৮ আরা মাছ
১৯ মালি জার
২০ সুব্রত কচ্ছপ
২১ নমি নীলপদ্ম
২২ অ্যাগিও নেমি শাঁখ
২৩ পার্শ্বনাথ ফণাতোলা সাপ
২৪ মহাবীর সিংহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন for "মহাবীর ও জৈনধর্মের ইতিহাস: (History of Mahabir and Jainism)."