কুষাণ সাম্রাজ্য ও সম্রাট কণিষ্ক: (Kanishka).


কুষাণ সাম্রাজ্যের আদি ইতিহাস [Kushana Invasion]:

মৌর্য সম্রাজ্যের পতনের পর যে সমস্ত বৈদেশিক জাতি ভারতে অনুপ্রবেশ করে ছিল, তাদের মধ্যে কুষাণরাই ছিল সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য। মৌর্যদের পর তারাই প্রথম একটি বিরাট সাম্রাজ্য স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিল। কুষাণদের ভারতে প্রবেশের ইতিহাস অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক। চিনের উত্তর-পশ্চিম অংশে ইউ-চি নামে এক যাযাবর জাতি বাস করত। হিউঙ-নু নামে অপর এক যাযাবর জাতির তাড়া খেয়ে তারা সিরদরিয়া নদীতীরবর্তী অঞ্চলে এসে সেখান থেকে শকদের বিতাড়িত করে বসবাস করতে শুরু করে। কিন্তু হিউঙ-নু রা এই অঞ্চল থেকেও তাদের উৎখাত করায় তারা আবার শকদের (যারা ইতিপূর্বে তাদের তাড়া খেয়ে ব্যাকট্রিয়ায় বসতি স্থাপন করেছিল) ব্যাকট্রিয়া থেকে উৎখাত করে। শকেরা বাধ্য হয়ে ভারত আক্রমণ করে। ব্যাকট্রিয়ায় আসার পর ইউ-চিদের দলগত সংহতি বিনষ্ট হয় ও তারা পাঁচটি পৃথক শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়। কুষাণরা ছিল এই পাঁচ গোষ্ঠীর অন্যতম। চৈনিক ঐতিহাসিক সুমা-কিয়েনের মত অনুযায়ী কুজল কদফিসেস নামে জনৈক ইউ-চি ঐ পাঁচটি গোষ্ঠীকে পুনরায় ঐক্যবদ্ধ করেন ও ভারতে প্রবেশ করে কাবুল ও কাশ্মীর দখল করেন। এই কুজুল কদফিসেস ছিলেন কুষাণ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। কুজুল কদফিসেস মারা গেলে তাঁর পুত্র বিম কদফিসেস রাজা হন।

কুষাণ সম্রাট কণিষ্ক [Kanishka]:
কণিষ্ক ছিলেন কুষাণ বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা। তাঁর সঙ্গে কুজুল ও বিম কদফিসেসের কী সম্পর্ক ছিল, তা সঠিকভাবে জানা যায় না। অনেকে মনে করেন তাঁর সঙ্গে এই বংশের প্রথম দুটি রাজার সঙ্গে কোনো রক্তের সম্পর্ক ছিল না। কণিষ্কের আমলেই কুষাণ সাম্রাজ্য সর্বাপেক্ষা বেশি বিস্তার লাভ করে ও উত্তর ভারতের ইতিহাসে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কণিষ্কের সিংহাসন আরোহণের তারিখ সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। তবে অধিকাংশ পণ্ডিতই মনে করেন ৭৮ খ্রিস্টাব্দে 'শকাব্দ' নামে যে বর্ষগণনা শুরু হয়, কণিষ্ক ছিলেন তার প্রবর্তক। এই সূত্র অনুসারে কণিষ্ক ৭৮ খ্রিস্টাব্দেই সিংহাসনে আরোহণ করেন।

কণিষ্কের রাজ্যজয় [Extension of Empire]:
কণিষ্কের রাজ্যজয় ও সাম্রাজ্যের সঠিক সীমা রেখা স্পষ্ট নয়। হিউয়েন সাঙের (বা সুয়ান সাঙের) মতে কণিষ্কের বিশাল সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল পুরুষপুর বা বর্তমান পেশোয়ায়। প্রত্নতাত্ত্বিক সূত্রে জানা যায় তাঁর রাজ্য গান্ধার ও সুইবিহার থেকে পূর্বে অযোধ্যা ও বারাণসী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। কলহনের রচনা থেকে জানা যায় কাশ্মীর তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। সাকেত ও পাটলিপুত্রের রাজাদের সঙ্গেও তাঁর সংঘর্ষের কথা সাহিত্যিক উপাদান থেকে জানা যায়। কারো কারো মতে বিহার ও বাংলা তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। পশ্চিম ভারতে সৌরাষ্ট্র ও কাথিয়াবাড়ে কুষাণ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলে দাবি করা হয়। কিন্তু এখানকার শক ক্ষত্রপরা সত্য সত্যই কণিষ্কের অধীনতা মনে চলতেন কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য থেকে মনে হয় কণিষ্কের সাম্রাজ্য উত্তরে কাশ্মীর থেকে দক্ষিণে সাঁচী ও পশ্চিমে সিন্ধু উপত্যকা থেকে পূর্বে বারাণসী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

ভারতের বাইরে সাম্রাজ্য বিস্তার [Extension of Empire outside India]: 
ভারতের বাইরে কণিষ্ক তাঁর সাম্রাজ্য বৃদ্ধির চেষ্টা করেছিলেন। দাবি করা হয় যে, তিনি পার্থিয়ান ও চিনদের পরাজিত করেন এবং কাশগড়, ইয়ারখন্দ ও খোটান অধিকার করেন। তিনি সম্ভবত মধ্য এশিয়ায় অবস্থিত গোবি মরুভূমি পর্যন্ত স্থান নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। হিউয়েন সাঙের রচনা থেকে জানা যায়, তিনি চিনের সম্রাটের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে পূর্ব তুর্কিস্থান দখল করেন। কিন্তু পরে তিনি চিনাদের হাতে পরাজিত হন। চিনের বিরুদ্ধে তাঁর সংঘর্ষের সঠিক ও নির্ভরযোগ্য বিবরণ পাওয়া যায় না। তবে অনুমান করা যায় যে, চিনে তাঁর আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত হয় নি।

কণিষ্কের ধর্মমত [Spread of Buddhism]:
ভারতের ইতিহাসে কণিষ্কের স্থান ও গুরুত্ব অবশ্য কেবল মাত্র একজন কৃতি ও দক্ষ সেনানায়ক হিসাবে নয়। বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষক হিসাবে ও ভারতীয় সংস্কৃতিতে তাঁর অবদানের জন্যই কণিষ্ক চিরস্মরণীয় হইয়ে থাকবেন। তিনি নিজে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন ও পুরুষপুরে একটি বহতল চৈত্য নির্মাণ করেন। অশোকের পর তাঁর সময়েই বৌদ্ধধর্ম পুনরায় রাজানুগ্রহ লাভ করে। তাঁর সময়ে বৌদ্ধধর্ম হীনযান ও মহাযান- এই দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। ভারতের বাইরে বৌদ্ধধর্ম প্রচারে কণিষ্ক সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তাঁর প্রচেষ্টায় বৌদ্ধধর্ম খোটান, চিন, জাপান ও কোরিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। স্মিথের মতে, বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে কণিষ্ক ছিলেন দ্বিতীয় অশোক। বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষক হলেও কণিষ্ক অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সহনশীল ছিলেন।

কুষাণ শিল্প ও সংস্কৃতি [Art and Culture]:
সাহিত্য ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কণিষ্ক উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন। বুদ্ধচরিত রচয়িতা অশ্বঘোষ, বৌদ্ধ দার্শনিক নাগার্জুন, বৌদ্ধসাহিত্যিক বসুমিত্র, স্বনামধন্য চিকিৎসক চরক, স্থপতি এজেসিলাস রাজনীতিবিদ মাথর প্রভৃতি মনীষীগণ তাঁর রাজত্ব কালেই আবির্ভুত হয়েছহিলেন। তিনি অসংখ্য বৌদ্ধ বিহার, স্তুপ ও চৈত্য নির্মাণে উদ্যোগী হয়েছিলেন। তাঁরই সময়ে সারনাথ, মথুরা, গান্ধার ও অমরাবতীতে চারটি পৃথক শিল্পরীতির আবির্ভাব ঘটেছিল।

কণিষ্কের কৃতিত্ব [Achievement]:
বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর ও গুপ্তযুগের অভ্যুত্থানের আগে ভারত ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ নরপতির মর্যাদা কণিষ্কেরই প্রাপ্য। তবে প্রশাসক হিসাবে কণিষ্কের মূল্যায়ন করা সহজসাধ্য কাজ নয়, কারণ তাঁর রাজ্য শাসন পদ্ধতি সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান খুবিই সীমিত। তবে অনুমান করা যেতে পারে শাসক হিসাবেও তিনি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। নচেৎ এত বড়ো সাম্রাজ্য তিনি টিকিয়ে রাখতে পারতেন না। বিদেশি হলেও কণিষ্ক যে ভাবে ভারতীয় জীবনধারার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন, তাঁর সেই আন্তরিকতা উচ্চ প্রশংসার যোগ্য।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন for "কুষাণ সাম্রাজ্য ও সম্রাট কণিষ্ক: (Kanishka)."