ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা ও তার কার্যাবলী: (Indian National Congress and its functions).


১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে লর্ড ড্যাফরিনের আমলে অ্যালান অক্টোভিয়াম হিউম নামে এক ব্রিটিশ কর্মচারী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের ২৮শে ডিসেম্বর বোম্বে শহরের গোকুল দাস তেজপাল সংস্কৃত কলেজে ৭২ জন সদস্য নিয়ে ভারতে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা হয়। যার প্রথম সভাপতি ছিলেন উমেশচন্দ্র ব্যানার্জি।


ভারতের জাতীয় কংগ্রেস গঠনের উদ্দেশ্য:
যেসব উদ্দেশ্যে ভারতে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করা হয় সেগুলি হল

ভারতীয়দের উদ্দেশ্য—
  •  ভাষাগত ও ধর্মীয় বৈচিত্রে ভরা ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের দেশপ্রেমীদের মধ্যে পারস্পরিক বন্ধুত্ব ও একাত্মতা গড়ে তোলা।
  •  সম্প্রীতির দ্বারা জাতি, ধর্ম, প্রাদেশিকতার তুচ্ছ সংকীর্ণতা দূর করে জাতীয় সংহতির পথ প্রশস্ত করা।
  •  শিক্ষিতদের সুচিন্তিত মতামত গ্রহণ করে সামাজিক ও অন্যান্য সমস্যা সমাধানের উপায় নির্ণয় করা।
  •  ভারতের রাজনৈতিক অগ্রগতির জন্য ভবিষ্যৎ কর্মসূচি গ্রহণ করা।

হিউমের উদ্দেশ্য—
রজনী পামদত্ত, বিপান চন্দ্র ও ওয়েডারবার্ন প্রমুখের ধারণায় হিউমের উদ্দেশ্য ছিল—

  •  ব্রিটিশ শাসনের প্রতি ভারতবাসীর মনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের প্রতিরোধরূপে (Safety Valve) ভারতীয়দের নেতৃত্বেই একটি রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠা করা।
  •  শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়কে রাজনৈতিক আন্দোলনগুলির সামনের সারিতে নিয়ে আসা এবং তাদের দ্বারাই এক সর্বভারতীয় দল প্রতিষ্ঠা করা।
  •  ভারতবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষা সাংবিধানিক পদ্ধতিতে রূপায়িত করার জন্য একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করা।

ডাফরিনের উদ্দেশ্য—
লালা লাজপত রায়, উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের মতে, কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ডাফরিনের উদ্দেশ্যগুলি ছিল—

  •  এক সর্বভারতীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠনের মাধ্যমে ভারতবাসীর সমস্যাগুলি সরকারের গোচরে আনা।
  •  ব্রিটিশ শাসনের প্রতি অনুগতদের ব্রিটিশবিরোধীদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া।

জাতীয় কংগ্রেসের কিছু গুরুত্বপূর্ণ অধিবেশন/ সভাপতি/ তাৎপর্য:

সাল স্থান সভাপতি তাৎপর্য
১৮৮৫ বোম্বে উমেশচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় প্রথম অধিবেশন
১৮৮৬ কলকাতা দাদাভাই নৌরজী সাংবিধানিক সংস্কার প্রস্তাব
১৮৮৭ মাদ্রাজ বদরুদ্দীন তৈয়বজি প্রথম মুসলিম সভাপতি
১৮৮৮ এলাহাবাদ জর্জ উইলি প্রথম ইংরেজ সভাপতি
১৮৮৮ বোম্বে উইলিয়াম ওয়েডারবার্ন শেষ ইংরেজ সভাপতি
১৮৯০ কলকাতা ফিরোজ শাহ মেহতা -
১৮৯৫ পুণা সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি -
১৮৯৬ কলকাতা রহিমতুল্লাহ সাহনি রবীন্দ্রনাথের সুরে প্রথম বন্দেমাতরম গাওয়া হয়
১৯০২ আমেদাবাদ সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি -
১৯০৫ বেনারস গোপালকৃষ্ণ গোখলে বয়কট আন্দোলনকে সমর্থন
১৯০৬ কলকাতা দাদাভাই নৌরজি স্বরাজ শব্দটি প্রথম ব্যবহার
১৯০৭ সুরাট রাসবিহারী ঘোষ নরমপন্থী ও চরমপন্থীর বিভাজন
১৯১১ কলকাতা বিষেণ নারায়ণ ধর জনগণমন-অধিনায়ক প্রথম গাওয়া হয় (২৭ ডিসেম্বর)
১৯১৬ লক্ষ্ণৌ অম্বিকা চরণ মজুমদার নরমপন্থী ও চরমপন্থীদের মিলন
১৯১৭ কলকাতা অ্যানি বেসান্ত প্রথম মহিলা সভাপতি (বিদেশি)
১৯২০ কলকাতা (বিশেষ) লালা লাজপত রায় অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তাব গ্রহণ
১৯২০ নাগপুর বিজয় রাঘবাচারিয়া -
১৯২১ আমেদাবাদ চিত্তরঞ্জন দাস (বন্দী ছিলেন) প্রথম কার্যনির্বাহী সভাপতি
১৯২২ গয়া চিত্তরঞ্জন দাস স্বরাজ দল গঠনের প্রস্তাব
১৯২৪ বেলগাঁও মহাত্মা গান্ধী প্রথম ও শেষবারের জন্য সভাপতি
১৯২৫ কানপুর সরোজিনী নাইডু প্রথম ভারতীয় মহিলা সভাপতি
১৯২৮ কলকাতা মতিলাল নেহেরু অখিল ভারত যুব কংগ্রেস গঠন
১৯২৯ লাহোর জহরলাল নেহেরু পূর্ণ স্বরাজের দাবি
১৯৩০ অধিবেশন হয়নি জহরলাল নেহের -
১৯৩১ করাচি বল্লভ ভাই প্যাটেল ভারতের মৌলিক অধিকারের প্রস্তাব
১৯৩৬ জহরলাল নেহেরু ভারত শাসন আইন ১৯৩৫ গৃহীত
১৯৩৭ ফয়েজপুর জহরলাল নেহেরু প্রথম গ্রাম্য অধিবেশন
১৯৩৮ হরিপুরা সুভাষচন্দ্র বসু জহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বে পরিকল্পনা কমিশন গঠন
১৯৩৯ ত্রিপুরি সুভাষচন্দ্র বসু প্রথম নির্বাচিত সভাপতি এবং পরে পদত্যাগ
১৯৪০ রামগড় মৌলানা আবুল কালাম আজাদ প্রথম কম বয়সী সভাপতি, জাতীয় শিক্ষানীতি গৃহীত
১৯৪৬ মিরাট জে.বি. কৃপালিনী স্বাধীনতার সময়ের সভাপতি
১৯৪৭ দিল্লি রাজেন্দ্র প্রসাদ ভারত বিভাগ আইন মানা হয়



কংগ্রেস দল সম্পর্কে কয়েকটি কথা:

কংগ্রেসকে ধ্বংসাত্মক শক্তির প্রতিরোধকের (Safety Valve) সাথে তুলনা করেছেন হিউম মতান্তরে লালা লাজপত রাই।

জিন্না কংগ্রেসকে ক্ষমতা লোভে মত্ত এক সংস্থা বলেছেন।

কংগ্রেসকে আনুবীক্ষণিক (Microscopic minority)/সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধি/বাবুশ্রেণির সংগঠন বলেছেন লর্ড ডাফরিন।

কংগ্রেসের শান্তিপূর্ণ ও স্বাভাবিক মৃত্যু চেয়েছিলেন লর্ড কার্জন।

কংগ্রেসকে তিনদিনের তামাশা বলেছেন অশ্বিনী কুমার দত্ত।

জাতীয় কংগ্রেসের সৃষ্টি হল হিউম-ডাফরিনের ষড়যন্ত্রের ফলস্বরূপ বলেছেন রজনীপাম দত্ত।


অস্ত্রবিহীন গৃহযুদ্ধ হল কংগ্রেসী আন্দোলন সৈয়দ আহমেদ/থিয়েডার বেক।

স্বায়ত্বশাসনই হল ভারতের দরিদ্র ও দুর্বলতার মূল প্রতিকার দাদাভাই নৌরজী।

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসকে অরবিন্দ ‘ভারতীয় বিজাতীয় কংগ্রেস বলেছেন।

১৯৩৩, কলকাতা নেল্লি সেনগুপ্তা প্রথম বাঙালি মহিলা সভাপতি৷

☞ ১৯৪১-১৯৪৫ সালের মধ্যে কোনো কংগ্রেস অধিবেসন বসেনি। কারণ এসময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল এবং কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতাগণদের মধ্যে অধিকাংশই জেলে ছিলেন। মৌলনা আবুল কালাম আজাদ এ সময় কংগ্রেসের সভাপতি হিসাবে কাজ চালান।

সবচেয়ে বেশি সময় ধরে কংগ্রেসের সভাপতি থেকেছেন মৌলনা আবুল কালাম আজাদ।

জাতীয় কংগ্রেসের সর্বকনিষ্ঠ সভাপতি মৌলানা আবুল কালাম আজাদ।

সবচেয়ে বেশিবার কংগ্রেস সভাপতি হয়েছেন জওহরলাল নেহেরু (১৯২৯, ১৯৩৬, ১৯৩৭) এবং দাদাভাই নৌরজী (১৮৮৬, ১৮৯৩, ১৯০৬)।

অ্যালান অক্টাভিয়ান হিউম জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

জাতীয় কংগ্রেস লন্ডনে প্রতিষ্ঠা করে ব্রিটিশ কমিটি এবং ‘INDIA' নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়।

☞ ১৮৮৫-১৯০৫ খ্রীঃ কংগ্রেসের নরমপন্থী অধ্যায়। (Moderate)

☞ ১৯০৫ সালের পর থেকে কংগ্রেসের লক্ষ্য হল স্বায়ত্বশাসন।

১৯০৫-১৯১৯ সশস্ত্র সংগ্রাম (চরমপন্থী অধ্যায়)।

১৯৩৪-১৯৪৭ সম্পূর্ণ স্বাধীনতা অধ্যায়।

নরমপন্থী নেতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন দাদাভাই নৌরজী, বদরুদ্দীন তৈয়বজী, ফিরোজ শাহ মেহতা, আনন্দ চারলু, গোপাল কৃষ্ণ গোখলে, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দমোহন বসু, রমেশচন্দ্র দত্ত প্রমুখ।

☞ নরমপন্থীরা আবেদন-নিবেদন-প্রতিবাদের রাজনীতিতেই সন্তুষ্ট ছিলেন। এই পদ্ধতিকে অনেক ঐতিহাসিক রাজনৈতিক ভিক্ষাবৃত্তি বলে বর্ণনা করেছেন।

চরমপন্থীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন বাল গঙ্গাধর তিলক (মহারাষ্ট্র), বিপিনচন্দ্র পাল (বাংলা), লালা লাজপৎ রায় (পাঞ্জাব), অরবিন্দ ঘোষ (বাংলা) প্রমুখ।

☞ 'আমাদের ব্যর্থতার মধ্যেই ভবিষ্যতের মহান সাফল্যের শক্তি লুকিয়ে আছে' বক্তা হলেন গোপাল কৃষ্ণ গোখলে।

জওহরলাল নেহেরু ও মৌলানা আজাদ ছিলেন ক্রীপস মিশনের সহিত সরকারিভাবে কংগ্রেসের পক্ষে দরকষাকষি করার জন্য মনোনীত প্রতিনিধি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন for "ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা ও তার কার্যাবলী: (Indian National Congress and its functions)."