মৌর্য সম্রাট অশোক [Ashoka] (আনুমানিক ২৭৩-২৩২ খ্রি.পূ.):


চন্দ্রগুপ্তের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র বিন্দুসার (৩০০-২৭৩ খ্রি.পূ.) অমিত্রঘাত উপাধি নিয়ে মগধের সিংহাসনে বসেন। তিব্বতীয় ঐতিহাসিক তারানাথের মতে বিন্দুসার সুদূর দাক্ষিণাত্য পর্যন্ত সাম্রাজ্য বিস্তার করেন। বিন্দুসারের মৃত্যুর পর অশোক মগধের সিংহাসনে বসেন।


অশোকের কলিঙ্গযুদ্ধ জয় [The Conquest of Kalinga War]:
অশোক জীবনে একটিমাত্র যুদ্ধ করেছিলেন। সেই যুদ্ধ হল কলিঙ্গের বিরুদ্ধে। দক্ষিণ ভারতের সঙ্গে স্থল ও জলপথে যোগাযোগের জন্য কলিঙ্গ জয় জরুরি ছিল। অশোক অনায়াসেই কলিঙ্গ জয় করেন। কিন্তু যুদ্ধের ভয়াবহ রূপ ও রক্তক্ষয় দেখে তাঁর মনে অনুশোচনা হয়। যুদ্ধ ত্যাগ করে তিনি বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন ও ধর্মপ্রচারে মন দেন। অবশ্য  বর্তমানে আব্রাহাম এরিলিসহ অনেক আধুনিক গবেষক মনে করেন অশোক কলিঙ্গ যুদ্ধের আগেই বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। এরপর তিনি আর যুদ্ধ করেন নি। তা করবার আর দরকারও হয়নি, কারণ নতুন করে রাজ্যজয়ের আর প্রয়োজন ছিলনা। ড. রোমিলা থাপার মনে করেন এটিই অশোকের পরবর্তীকালে যুদ্ধ না করার মূল কারণ। যুদ্ধ ত্যাগ করলেও কলিঙ্গ কিন্তু তিনি কলিঙ্গবাসীকে ফিরিয়ে দেন নি। যাই হোক, এই যুদ্ধের ফলে মৌর্য সাম্রাজ্যের চুড়ান্ত বিস্তৃতি ঘটেছিল। উত্তরে কাবুল উপত্যকা ও যোন, কম্বোজ ও গান্ধার থেকে দক্ষিণে গোদাবরী-কৃষ্ণা অববাহিকায় অন্তরাজ্য ও উত্তর মহীশূর পর্যন্ত তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল। পশ্চিমে সোপারা ও গিরনাথ থেকে পূর্বে ধৌলি ও জোগাড় পর্যন্ত অঞ্চল তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। বাংলা তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল কিনা, বলা কঠিন; কারণ এখানে তাঁর কোনো শিলা লিপি আবিষ্কৃত হয় নি। তবে হিউয়েন সাঙ তাম্রলিপ্ত (তমলুক), সমতট (পূর্ব বাংলা), পুন্ড্রুবর্ধন (উত্তর বাংলা) প্রমুখ স্থানে অশোকের স্তুপ দেখেছিলেন। তাই অনেকে মনে করেন বাঙলা অশোকের সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। তবে কামরূপ তাঁর সাম্রাজ্যের বাইরে ছিল।

অশোকের ধর্ম [Asoka’s Dhamma]:
বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হবার আগে অশোক ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রতি নিষ্ঠাবান ছিলেন। কাশ্মীরের ঐতিহাসিক কলহনের মতে তিনি ছিলেন শিবের উপাসক। সম্রাট অশোক বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন ও একজন সাধারণ উপাসক ছিলেন; তিনি সর্বত্যাগী সন্নাসী হন নি। সর্বদাই তিনি রাজধর্ম ও রাজার কর্তব্য পালন করে গেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বৌদ্ধধর্মের উপাসক হলেও জনগণের মধ্যে তিনি যে ধর্মমত প্রচার করেন, তা প্রকৃতই বৌদ্ধধর্ম ছিল কিনা, তা নিয়ে অনেক ঐতিহাসিক ভিন্ন মত পোষণ করেন। তিনি তাঁর প্রচারিত ধর্মকে বৌদ্ধধর্ম না বলে শুধু ধম্ম বা ধর্ম বলে অভিহিত করেছেন। জনগণের মধ্যে প্রচারের জন্য যে সব আদর্শ তিনি স্তম্ভলিপি ও শিলালিপির মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন, তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সাধারণ মানুষের নৈতিক ও মানষিক উৎকর্ষ বিধান। কোনো বিশেষ ধর্মের আদর্শ এর মধ্যে প্রতিফলিত হয়নি। মানবতার আদর্শ ও সর্বধর্মের সারবস্তু তিনি জনসাধারণের মধ্যে তুলে ধরেন। তিনি মনে করতেন সাধারণ গৃহীর পথ আর সংসারত্যাগী বৌদ্ধভিক্ষুর পথ এক নয়। তাই সহজবোধ্য ভাষায় তিনি কয়েকটি নৈতিক অনুশাসন জনগণের মধ্যে প্রচার করেন। এই নৈতিক অনুশাসন হল দয়া, দান, সত্যানুরাগ, শুচিতা, নম্রতা, সংযম, ভাবশুদ্ধি, সাধুতা, অল্প ব্যয়, অল্প সঞ্চয়, অহিংসা, সৎ আচরণ ইত্যাদি। তিনি নিষ্ঠুরতা, ক্রোধ, ঈর্ষা ইত্যাদির থেকে বিরত থাকার উপদেশ দিয়েছেন। জোর দিয়েছেন পিতা-মাতা ও গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন, দাস ও ভৃত্যদের প্রতি সৎ ব্যাবহার, অন্য ধর্ম ও সম্প্রদায়ের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন ইত্যাদির উপর। তিনি নিজে ব্রাহ্মণ ও আজীবকদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। পরধর্মসহিষ্ণুতা তাঁকে মহান করেছেন। রামশরণ শর্মা, ব্রতীন মুখোপাধ্যায়, আব্রাহাম এরিলসহ অনেকেই অশোকের পরধর্মশহিষ্ণুতার প্রশংসা করেছেন। তিনি যা প্রচার করতেন, তা মেনেও চলতেন।

অশোকের ধর্মপ্রচার [Asoka’s Missionary Activities]:
অশোক তাঁর নৈতিক অনুশাসনকে কেবলমাত্র শিলালিপির মধ্যে আবদ্ধ রাখেন নি। এই সব আদর্শ জনগণ যাতে নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে তার জন্য তিনি যুত, রাজুক, ধর্মমহামাত্র প্রভৃতি কর্মচারীদের নিযুক্ত করেন। নারীদের নৈতিক উন্নতির জন্য বিশেষ কর্মচারী নিযুক্ত করা হয়। তা ছাড়া উৎসব অনুষ্ঠান, দিব্যরূপ প্রদর্শন (বিমান দর্শন) প্রভৃতি বিভিন্ন বিনোদনের  মাধ্যমেও তিনি ধর্ম প্রচার করেন। তিনি নিজে বিহার যাত্রার পরিবর্তে ধর্মযাত্রা শুরু করেন। ধর্ম যাত্রার অর্থ গৌতম বুদ্ধের স্মৃতিবিজরিত স্থানগুলিতে গিয়ে বুদ্ধের বাণী প্রচার করা। ভেরী ঘোষের পরিবর্তে ধর্মঘোষ ধ্বনিত হয়। ভারতের বাইরেও যাতে ধর্মের আদর্শ ছড়িয়ে পড়ে, তার জন্য তিনি রাজ্যবিজয় নীতির পরিবর্তে ধর্মবিজয় নীতি গ্রহণ করেন। তিনি বিভিন্ন দিকে বৌদ্ধ প্রচারক প্রেরন করেন। সিরিয়া, মিশর, ম্যাসিডন এপিরাসে দূত পাঠিয়েছিলেন বলে অশোক দবি করেন। সিংহলে (শ্রীলঙ্কা) নিজ পুত্র বা ভ্রাতা মহেন্দ্রকে তিনি পাঠিয়ে ছিলেন। বিদেশে তার এই ধর্ম প্রচার কতদূর সফল হয়ে ছিল তা বলা কঠিন।

অশোকের জনহিতকর কাজ [Asoka’s Welfare Activities]:
অশোক তাঁর শিলালিপিতে বলেছেন 'সকল মানুষই আমার সন্তান'। সন্তান তুল্য প্রজাদের সুখী করা, তাদের হিতসাধনকরা তাঁর জীবনের উদ্দেশ্য ছিল। তিনি সারা জীবন রাজ্যব্যাপী জলকষ্ট দূর করতে কূপ খনন করিয়েছিলেন, জনসাধারণের সুবিধার জন্য রাস্তার দুধারে বৃক্ষরোপণ করিয়েছিলেন, আম্রকুঞ্জ স্থাপন করিয়েছিলেন, পশু চিকিৎসার ব্যাবস্থা করিয়েছিলেন। অপরাধীদের জন্য শাস্তির  পরিমাণ লাঘব করা করেছিলেন। অশোক মৃত্যু দন্ড রহিত করেন নি। তিনি মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত ব্যাক্তিকে তিনদিনের অবকাশ লাভের সুযোগ দিয়েছিলেন। পশু হত্যা নিষিদ্ধ করেন।

ইতিহাসে অশোকের স্থান [Asoka’s place in History]:
পৃথিবীর ইতিহাসে অশোক এক ব্যাতিক্রমী সম্রাট। আলেকজান্ডার, জুলিয়াস সিজার ও নেপোলিয়নের মতো তিনি দিগ্বীজয়ী বীর ছিলেন না। রাজ্যবিজয় নয় ধর্মবিজয় ছিল তাঁর নীতি। প্রজাদের হৃদয় জয় করা ছিল তাঁর জীবনের লক্ষ্য। প্রজাকল্যাণ ছিল তাঁর রাজধর্ম। প্রজাদের তিনি সন্তানের মতো দেখতেন। জনহিতকর কাজ করেই তিনি তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্য শেষ করেননি। ধর্মের মাধ্যমে তিনি প্রজাদের নৈতিক ও মানসিক উন্নতির জন্য আন্তরিক ও ঐকান্তিক চেষ্টা করেছিলেন। তিনি কেবল ভারতবাসীর আত্মার উন্নতির কথা চিন্তা করেননি। সমগ্র মানবজাতির নৈতিক ও পারমার্থিক উন্নতির এমন দরদি প্রয়াস পৃতিবীর ইতিহাসে আর কোনো রাজার মধ্যে দেখা যায় নি। ক্ষমা ও দয়া তাঁর কাছে দুর্বলতা ছিল না। রাজধর্ম পালনে তিনি কঠোরতা ও কোমলতার সেতুবন্ধন ঘটিয়ে ছিলেন। 'তিনি দন্ডের সহিত ক্ষমা, শক্তির সহিত সংযমের এবং আদর্শের সহিত বাস্তবের ঐক্য স্থাপন করিয়াছিলেন'। প্রজাকল্যাণ যদি শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হয়, মানবতাই যদি মানুষ্যত্ব বিচারের মানদন্ড হয়, তাহলে অশোক নিঃসন্দেহে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্রাট। এইচ. জি. ওয়েলেস বলেছেন- 'ইতিহাসে শত সহস্র সম্রাটের মধ্যে কেবল অশোকের নামই একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের মত আলো বিকিরণ করছে। কনস্ট্যানটাইন বা শার্লামেন অপেক্ষা তাঁর নাম আজও মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছে'। ড. হেমচন্দ্র রায়চৌধুরির মতে- 'অশোকের মধ্যে ছিল চন্দ্রগুপ্তের উদ্যম, সমুদ্রগুপ্তের বহুমুখী প্রতিভা ও আকবরের উদারতা'।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন for "মৌর্য সম্রাট অশোক [Ashoka] (আনুমানিক ২৭৩-২৩২ খ্রি.পূ.): "