গুপ্তসম্রাট সমুদ্রগুপ্ত: (The Gupta Emperor Samudragupta).


গুপ্ত রাজাদের মধ্যে সমুদ্রগুপ্ত ছিলেন শ্রেষ্ঠ। শৌর্য-বীর্য, চারিত্রিক দৃঢ়তা ও সংস্কৃতির প্রতি পৃষ্ঠপোষকতার জন্য তিনি ভারত ইতিহাসে একটি অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছেন। তাঁর সিংহাসন আরোহণের সঠিক সময় বলা কঠিন। সম্ভবত তিনি ৩২০ খ্রিস্টাব্দের পর সম্রাট পদে অভিষিক্ত হন। ড. রোমিলা থাপারের মতে, তিনি ৩৩৫ সাল নাগাদ পিতৃ সিংহাসন লাভ করেন।


সমুদ্রগুপ্তের সাম্রাজ্য সীমা (Samudragupta as a Conqueror):
সিংহাসনে বসার পরই সমুদ্রগুপ্ত রাজ্যবিস্তারে মনযোগ দেন। অশোকের শান্তি ও অহিংসা নীতি বর্জন করে তিনি সামরিক শক্তির সাহায্যে এক সাম্রাজ্যবাদী নীতি অনুসরণ করেন। সভাকবি হরিষেণের এলাহাবাদ প্রশস্তি থেকে তাঁর বিজয় কাহিনি জানতে পারা যায়। এই লিপিতে অনেক পরাজিত রাজার নামের উল্লেখ আছে। সমুদ্রগুপ্ত যে সব রাজ্য  জয় করেছিলেন, তাদের মোটামুটি পাঁচভাগে ভাগ করা যেতে পারে।

  •  প্রথমভাগে রয়েছে গঙ্গা-যমুনার মধ্যবর্তী এলাকার রাজ্যগুলি। এই অঞ্চলের রাজাদের পরাজিত করে সমুদ্রগুপ্ত তাঁদের রাজ্য সরাসরি গুপ্ত সাম্রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত করেন।
  •  দ্বিতীয়ভাগে পড়ে পূর্ব হিমালয়স্থিত রাজ্যগুলি এবং নেপাল, বঙ্গ, আসাম প্রভৃতি সীমান্তবর্তী অঞ্চলের রাজ্যসমূহ। এখানকার রাজারা সমুদ্রগুপ্তের বাহুবলের পরিচয় পেয়েছিলেন। পাঞ্জাবের কয়েকটি প্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রকেও এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা যায়।
  •  তৃতীয়ভাগে রয়েছে বিন্ধ্য অঞ্চলের অটবিক রাজ্যগুলি।
  •  চতুর্থভাগে উল্লেখিত হয়েছে দক্ষিণ-ভারতে পরাজিত ১২ জন রাজার নাম।
  •  সবশেষে পঞ্চমভাগে শক ও কুষাণ রাজাদের নামের তালিকা।
সমুদ্রগুপ্তের রাজ্যজয়:
  •  উত্তর ভারতে সমুদ্রগুপ্ত যেসব রাজাকে পরাজিত করেন, তাঁদের মধ্যে অহিচ্ছত্ররাজ অচ্যুত (বেরিলী), মতিল (উত্তরপ্রদেশের পশ্চিমাঞ্চল),  বলবর্মন (অনেকের মতে কামরূপ রাজ), চন্দ্রবর্মণ (বাঁকুড়া জেলার গোলকর্ণ) ও রুদ্রদেবের (বুন্দেলখন্ড) নাম উল্লেখযোগ্য।
  •  দক্ষিণ ভারতে যে ১২ জন পরাজিত রাজার নাম পাওয়া গেছে, তাঁরা হলেন কোশলরাজ মহেন্দ্র (মহানদী উপত্যকা), মহাকান্তারের ব্যাঘ্ররাজ, কুরলের মন্তরাজ, পিষ্ঠপুর বা পিঠাপুরমের (গোদাবরী জেলা) মহেন্দ্রগিরি, কোট্টুরের (উত্তর তামিলনাড়ু) স্বামীদত্ত, এরন্ডপল্লের (উত্তর তামিলনাড়ু) দমন, কাঞ্চীর পল্লবরাজ বিষ্ণুগোপ, অবমুক্তর নীলরাজ (কাশ্মীর নিকটবর্তী অঞ্চল), বেঙ্গীর (কৃষ্ণা ও গোদাবরীর মধ্যাঞ্চল) হস্তিবর্মণ, পালক্করাজ (নেলোর) উগ্রসেন, দেবরাষ্ট্রের (ভিজাগাপত্তম) কুবের ও কুন্তলপুরের (উত্তর আর্কট) ধনঞ্জয়। এই রাজাদের পরাজিত করে সমুদ্রগুপ্ত তাঁদের রাজ্য ফিরিয়ে দেন। তাঁদের মৌখিক অনুগত্য ও করদানের সম্মতির বেশি অতিরিক্ত কিছু দাবি করেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন উত্তর ভারত থেকে সুদূর দক্ষিণ ভারত শাসন করা সম্ভব নয়।

এলাহাবাদ প্রশস্তি সভাকবি হরিষেণ রচনা করেন বলে এর মধ্যে কিছু অতিশয়োক্তি থাকতে পারে বলে অনেকে মনে করেন। পশ্চিম ভারতে তিনি শকদের ক্ষমতা বিনষ্ট করতে পারেন নি বলে মনে হয় । কুষাণ রাজাদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কও সঠিকভাবে জানা যায় না। চৈনিক সূত্রে জানা যায় সিংহলের রাজা মেঘবর্ণ বা মেঘবর্মণ তাঁর কাছে উপহার পাঠান এবং গয়াতে একটি বৌদ্ধমঠ নির্মাণের অনুমতি চান। অনেকে মনে করেন, যে দ্বীপের কথা চৈনিক সূত্রে বলা হয়েছে, তা আদৌ সিংহল নয়। এই সব সূত্রে কিছু অতিশয়োক্তি থাকলেও সমুদ্রগুপ্ত তাঁর দীর্ঘ ৪০ বছরের রাজত্বকালে অনেকগুলি বিজয় অভিযানে অংশ নিয়ে এক বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। তাঁর সাম্রাজ্য উত্তরে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে দক্ষিণে নর্মদা তীর পর্যন্ত ও পূর্বে ব্রহ্মপুত্র নদী থেকে পশ্চিমে চম্বল ও যমুনা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। অন্যান্য অঞ্চলের রাজারা তাঁর অধীন না হলেও কর দিতেন। তাঁর বিজয় নীতির ফলে গঙ্গা-যমুনা দোয়াব, রহিলখন্ড, পূর্ব মালবের কিছু অংশও তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। তা ছাড়া সমতট (পূর্ববঙ্গ), দাবাক (সম্ভবত আসামের নওগাঁও), কামরূপ, নেপাল, যৌধেয়, মদ্রক, আভীর প্রভৃতি উপজাতিও তাঁর বশ্যতা স্বীকার করেছিলেন।

সমুদ্রগুপ্তের কৃতিত্ব (Achievement of Samudragupta):
সমুদ্রগুপ্ত তাঁর সামরিক অভিযানে সাফল্যলাভের কারণে ভারতের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় স্থান দখল করে আছেন।

  •  তাঁর অসাধারণ প্রতিভার জন্যই তিনি গাঙ্গেও উপত্যকার একটি ক্ষুদ্র রাজ্য থেকে বিশাল সাম্রাজ্য স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আর্যাবর্ত থেকে সুদূর দাক্ষিণাত্য পর্যন্ত সফল সামরিক অভিযান তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর বহন করে। বিভিন্ন রাজাকে পরাজিত করে তিনি অশ্বমেধ যজ্ঞ করেন। ঐতিহাসিক ভি. স্মিথ তাঁকে ভারতের নেপোলিয়ান আখ্যা দিয়েছেন।
  •  তিনি কেবল সুদক্ষ যোদ্ধাই ছিলেন না, তিনি সাহিত্যিক, শাস্ত্রজ্ঞ, সংগীতজ্ঞ ও শিল্প-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক হিসেবেও  চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। সংস্কৃত পন্ডিত হরিষেণ ও বৌদ্ধ পন্ডিত বসুবন্ধু তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদারের মতে, সমুদ্রগুপ্তের অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভা ভারতের ইতিহাসে এক নব যুগের সূচনা করেছিল।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন for "গুপ্তসম্রাট সমুদ্রগুপ্ত: (The Gupta Emperor Samudragupta)."