মৌর্যবংশ [Maurya Dynasty]:


চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য [Chandragupta Maurya]:

মন্ত্রী কৌটিল্য বা চাণক্যের সহায়তায় চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য নন্দ বংশের শেষ রাজা ধননন্দকে সিংহাসনচ্যুত করে মৌর্য বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের  আমলেই (৩২৪-৩২০ খ্রি. পূ.) মগধ সম্রাজ্যের চরম বিস্তার ঘটেছিল। চন্দ্রগুপ্তের বংশ পরিচয় ও বাল্য জীবন সম্পর্কে অনেক তথ্যই সঠিকভাবে জানা যায় না। এক একটি সূত্রে এক এক রকম তথ্য পরিবেশিত হয়েছে।

  •  একটি সূত্র অনুসারে চন্দ্রগুপ্তের মা অথবা দিদিমা শূদ্রকন্যা মুরার নাম অনুসারে তাঁর বংশের নামকরণ হয়েছিল মৌর্যবংশ। অর্থাৎ তিনি শূদ্র বংশজাত। গ্রিক লেখক জাস্টিনও মনে করেন, চন্দ্রগুপ্ত কোনো নীচু বংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
  •  বৌদ্ধ সূত্রে বলা হয়েছে, তিনি ক্ষত্রিয় সন্তান। মধ্যযুগের লিপিতেও তাই উল্লেখ আছে।
  •  জৈন সূত্রে তাকে বলা হয়েছে ময়ূরপোষক, তিনি বিন্ধ্য পর্বতের জঙ্গলে ময়ূর পালকদের মধ্যে মানুষ হয়েছিলেন। তাই তাঁর বংশের নামকরণ হয়েছিল মৌর্যবংশ।

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য রাজ্যবিস্তার [Extension of the Empire]:
নন্দবংশের উচ্ছেদে তিনি যে কৌটিল্য বা চাণক্যের সহায়তা পেয়েছিলেন, তা ঐতিহাসিক সত্য। চন্দ্রগুপ্তের আর একটি উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব হল উত্তর-পশ্চিম ভারত থেকে গ্রিকদের বিতাড়ন। গ্রিক সেনাপতি সেলুকাসকে তিনি যুদ্ধে পরাজিত করেন (৩৫০ খ্রি.পূ.) এবং কাবুল, কান্দাহার, হিরাট ও বেলুচিস্তান দখল করেন। সেলুকাস তাঁর কন্যা হেলেন-এর সঙ্গে চন্দ্রগুপ্তের বিবাহ দেন। এইভাবে তিনি তাঁর সাম্রাজ্য মগধ থেকে সিন্ধুতীর পর্যন্ত বিস্তৃত করেন। তার পর তিনি মালয় ও কাথিয়াবাড় তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। তাঁর সাম্রাজ্য সীমা সৌরাষ্ট্র পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। তামিল সূত্রে জানা যায় একজন মৌর্য রাজা তিনেভেল্লি জেলা পর্যন্ত অঞ্চল দখল করেন। তবে এই মৌর্যরাজ চন্দ্রগুপ্ত না কোঙ্কনের কোনো মৌর্যরাজ, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। চন্দ্রগুপ্ত দাক্ষিণাত্য পর্যন্ত অগ্রসর হলেও তা তিনি সরাসরি নিজ অধিকারে রাখতে পেরেছিলেন বলে মনে হয় না। বাংলাও খুব সম্ভবত তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। এর আগে কোনো রাজার সাম্রাজ্যের আয়তন এত বড় ছিল না। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যই ছিলেন প্রথম নরপতি, যিনি প্রায় সর্বভারতীয় একটি সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। ড. হেমচন্দ্র রায়চৌধুরীর ভাষায় চন্দ্রগুপ্ত ছিলেন 'first historical founder of a great empire in India.'

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসনব্যবস্থা [Maurya Administration]:
চন্দ্রগুপ্ত যেমন সামরিক শক্তির পরিচয় দেন, তেমনি তিনি একজন দক্ষ প্রশাসকও ছিলেন। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র ও মেগাস্থিনিসের (সেলুকাস প্রেরিত গ্রিক দূত) ইন্ডিকা থেকে তাঁর শাসনব্যাবস্থার পরিচয় পাওয়া যায়।

  •  চন্দ্রগুপ্তের শাসনব্যাবস্থা ছিল স্বৈরতান্ত্রিক। রাজাই ছিল সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। আইন, বিচার, শাসন ও সামরিক ক্ষমতার শীর্ষে ছিলেন সম্রাট। তবে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হলেও তিনি শাসনকার্যে মন্ত্রিপরিষদের সাহায্য গ্রহণ করতেন। রাজা প্রয়োজনে মন্ত্রিপরিষদের সুপারিশ অগ্রাহ্য করতে পারতেন।
  •  রাজকার্যে সাহায্য করার জন্য বিভিন্ন কর্মচারী নিযুক্ত করা হত। এঁদের মধ্যে অমাত্যরা ছিলেন রাজস্ব, অর্থ, বিচার, প্রশাসন প্রভৃতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ পদে প্রতিষ্ঠিত। অর্থশাস্ত্র থেকে আমরা ১৮টি সর্বোচ্চ পদের (তীর্থ) নাম জানতে পারি, যার মধ্যে মন্ত্রী (মুখ্যমন্ত্রী), পুরোহিত, যুবরাজ ও সেনাপতি ছিলেন প্রধান। বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্ব থাকত অধ্যক্ষদের হাতে। অর্থশাস্ত্রে ৩২ জন অধ্যক্ষের নাম পাওয়া যায়। কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে জাতিগত বা সম্প্রদায়গত কোনো বাধা ছিল না। কর্মচারীদের নগদ বেতন দেওয়া হত। মৌর্য সম্রাট গুপ্তচর মারফত দেশের সব খবরাখবর রাখতেন।
  •  রাজা বিচার বিভাগের প্রধান হলেও গ্রাম ও শহরে বিশেষ বিচারালয় ছিল।
  •  মৌর্য যুগে উৎপন্ন শস্যের ১/৬ অংশ রাজস্ব হিসাবে গ্রহণ করা হত, যদিও প্রয়োজনে এই হার কমানো বা বাড়ানো হত। এই যুগে দু ধরনের করের কথা জানা যায়।
যথা- ভাগ ও বলি। ভাগ ছিল ভূমিকর। আর বলি ছিল এক বিশেষ ধরনের কর, যা জমি থেকে আদায় করা হত কয়েকজন কর্মচারীর বেতন প্রদানের জন্য।

  •  কর থেকে প্রাপ্ত অর্থের একটা বড়ো অংশ ব্যয়িত হত সামরিক খাতে। সামরিক বিভাগের দায়িত্ব ছিল ৩০ জন সদস্যবিশিষ্ট এক পরিষদের উপর, যা আবার ৫ জন সদস্য নিয়ে ৬ টি ভাগে বিভক্ত ছিল। এই বিভাগগুলি অশ্ব, রথ, হস্তী, পদাতিক, নৌ-বহর এবং খাদ্য ও পরিবহণের দায়িত্ব বহন করত।
  •  শাসন কার্যের সুবিধার জন্য মৌর্য সাম্রাজ্য কয়েকটি প্রদেশ এবং প্রদেশগুলি আবার অহর ও বিষয়ে (জেলা) বিভক্ত ছিল। প্রদেশের শাসনভার প্রধানত রাজ পরিবারের সদস্যদের দেওয়া হত। সবশেষে ছিল গ্রাম যার পরিচালনা করতেন গ্রামিক। চার পাঁচটি গ্রামের দায়িত্বে থাকতেন 'গোপ'। পাটলিপুত্রের শাসনদায়িত্ব ছিল ৩০ সদস্য বিশিষ্ট একটি পরিষদের হাতে, যা আবার ৫ জন সদস্য নিয়ে ৬ টি ভাগে বিভক্ত ছিল। এক একটী বিভাগ এক একটি বিষয়ের দায়িত্বে থাকতো। মৌর্য শাসনব্যাবস্থা দক্ষতার সঙ্গে প্রজাকল্যাণের মেলবন্ধন ঘটিয়েছিল।

মৌর্য সম্রাট অশোক সম্পর্কে জানতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন;

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন for "মৌর্যবংশ [Maurya Dynasty]:"