ভারতের সংবিধানে উল্লেখিত ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার আলোচনা করো;


সংবিধান প্রণয়নের সময় মূল সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটি যুক্ত ছিলনা। এরপর ১৯৭৬ সালে ৪২ তম সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটিকে প্রস্তাবনা অংশে যুক্ত করা হয়। ভারতীয় সংবিধানের ২৫ থেকে ২৮ নং ধারায় ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকারগুলি সংযুক্ত করা হয়েছে।

ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার ২৫(১) নং ধারা:
ভারতীয় সংবিধানের ২৫(১) নং ধারা অনুসারে সকল ব্যক্তিই সমানভাবে বিবেকের স্বাধীনতা অনুসারে ধর্মমত গ্রহণ, ধর্মপালন ও ধর্মপ্রচারের স্বাধীনতালাভ করবে। ব্যক্তির ধর্মাচরণ সংক্রান্ত কার্যকলাপের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র কোনোরূপ হস্তক্ষেপ করবে না এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদানে রাষ্ট্র অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকবে।

ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার নিয়ন্ত্রণ [২৫(২)-ক নং ধারা]:
তবে ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকারগুলি অবাধ নয়। রাষ্ট্র যেকোনো রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতা ও অখন্ডতা রক্ষার্থে যেকোনো ধরণের ধর্মীয় স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করতে পারে এবং ধর্মীয় কার্যকলাপকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে প্রবেশাধিকার [২৫(২)-খ নং ধারা]:
সামাজিক কল্যাণ, সামাজিক সংস্কারসাধন বা জনপ্রতিনিধিত্বমূলক হিন্দু ধর্ম প্রতিষ্ঠানগুলিতে সকল শ্রেণীর হিন্দুদের প্রবেশাধিকারের জন্য রাষ্ট্র আইন প্রণয়ন করতে পারে। এখানে হিন্দু বলতে হিন্দু ধর্মের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে শিখ, বৌদ্ধ, জৈন সকলকেই বোঝাবে।

ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ও প্রতিষ্ঠানের অধিকার [২৬ নং ধারা]: 
ভারতীয় সংবিধানের ২৬ নং ধারা অনুসারে বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও সম্প্রদায়গুলি বিভিন্ন অধিকার ভোগ করে। এই অধিকারগুলো হল -

  •  ধর্ম বা দানের উদ্দেশ্যে সংস্থা স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারবে।
  •  নিজ ধর্মীয় কার্যাবলী নিজেরাই পরিচালনা করতে পারবে।
  •  স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির মালিক হতে পারবে।
  •  নির্দিষ্ট বিধিবদ্ধ আইন অনুসারে তারা সেই সম্পত্তি পরিচালনা করতে পারবে।
  •  কোনো অজুহাতেই কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায় বা প্রতিষ্ঠান কোনো ব্যক্তি বা সভ্যকে বহিস্কার বা একঘরে করতে পারবে না।
  •  তবে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলির এই অধিকার অবাধ নয়। জন নিরাপত্তা, জনস্বার্থ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা, রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতা ও অখন্ডতা রক্ষা - ইত্যাদি ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ধর্মীয় সম্প্রদায় ও প্রতিষ্ঠানগুলির অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।    

ধর্মীয় কর আরোপ সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞা [২৭ নং ধারা]:
ভারতীয় সংবিধানের ২৭ নং ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ধর্ম বা ধর্মীয় সম্প্রদায় বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নিজ ধর্মের উন্নতি, প্রচার, রক্ষণাবেক্ষণ - ইত্যাদি কারণের জন্য নাগরিকদের কর প্রদানে বাধ্য করতে পারবে না বা কর ধার্য করতে পারবে না। ধর্মকর বিষয়ক অত্যাচার থেকে ভারতীয় নাগরিকদের নিষ্কৃতি দিতেই এই জাতীয় বাধা - নিষেধ আরোপিত হয়েছে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্ম ও শিক্ষা বিষয়ক বিধি ব্যবস্থা ২৮ নং ধারা: 
ভারতীয় সংবিধানের ২৮ নং ধারায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মশিক্ষা বিষয়ে কিছু বাধা-নিষেধ আরোপিত হয়েছে। যেমন -

  •  সম্পূর্ণরূপে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোনোরূপ ধর্মশিক্ষা প্রদান করা যাবে না।
  •  সরকার স্বীকৃত বা সরকারি অনুদানে আংশিকভাবে পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্ম শিক্ষা প্রদান করা গেলেও - শিক্ষার্থীকে ধর্ম শিক্ষা গ্রহণে বাধ্য করা যাবেনা। ধর্মশিক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের প্রাপ্ত বয়স্ক হতে হবে বা তাদের অভিভাবকের সম্মতিক্রমে ধর্মশিক্ষা দেওয়া যাবে।
  •  সম্পূর্ণরূপে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্ম শিক্ষা নিষিদ্ধ হয়নি।
  •  কোনো দাতা বা অছি কর্তৃক ধর্মশিক্ষার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্র কর্তৃক পরিচালিত হলেও তাতে ধর্মশিক্ষা প্রদান করা যাবে।

পরিশেষে বলা যায়, ভারত বহুধর্মাবলম্বী মানুষের আবাসস্থল। প্রতিটি ধর্মের আচার - আচরণ, রীতিনীতি, প্রথা, ধর্মবিশ্বাস - ভিন্ন ভিন্ন। ভারতের এই বৈসাদৃশ্যমূলক রূপটি ভারতীয় সংবিধানের প্রণেতাগণ উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাই ভারতকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশে পরিণত করতে তাঁরা সাংবিধানিক বিধিব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। ২৫ থেকে ২৮ নং ধারার ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকারগুলি নাগরিক ও বিদেশি সকলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
          কিন্তু বর্তমানে বেশ কিছু ঘটনা ও পরিস্থিতি ভারতীয় সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রটিকে কলুষিত করছে। মুম্বাই দাঙ্গা, গোধরা কান্ড, গুজরাট হত্যাকান্ড, বাবরি মসজিদ ধ্বংস - ইত্যাদি বিভিন্ন ঘটনা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। অতি সাম্প্রতিককালে কিছু ক্ষেত্রে উগ্র মৌলবাদী চিন্তা ভাবনার উন্মেষ ঘটেছে।
         তবে একথা ঠিক যে কিছু ঘটনা, রাজনৈতিক আদর্শ ইত্যাদির ফলে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র প্রশ্নের মুখে পড়লেও সামগ্রিকভাবে বিচার করলে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র আজও অটুট আছে। ডক্টর জাকির হোসেন, ফকরুদ্দিন আলি আহমেদ, ডক্টর এ পি জে আবদুল কালাম, জ্ঞানী জৈল সিং, দ্রোপদী মুর্মু  এঁরা সংখ্যালঘু হয়েও ভারতের রাষ্ট্রপতি পদে আছে এবং ছিলেন। রাজনৈতিক সংকীর্ণতার বাইরে সাধারণ জীবন যাত্রার ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিভেদ এখনো প্রকট হয়নি। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন for "ভারতের সংবিধানে উল্লেখিত ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার আলোচনা করো;"