ভূমিরূপ | সপ্তম শ্রেণীর ভূগোল | চতুর্থ অধ্যায়
১. ভূমিরূপ কাকে বলে?
উঃ- পৃথিবীর উপরিভাগ বা ভূপৃষ্ঠের সব জায়গা একইরকম নয়। কোথাও উঁচু, কোথাও ঢেউ-খেলানো, আবার কোথাও-বা নীচু সমতল। পৃথিবীপৃষ্ঠের ভূমির এই বৈচিত্র্যই হল ভূমিরূপ।২. অ্যাসথেনোস্ফিয়ার কাকে বলে?
উঃ- ভূত্বকের নীচে প্রায় ৭০০ কিমি গভীরতা পর্যন্ত যে থকথকে বা সান্দ্র বা অর্ধতরল স্তর রয়েছে, সেই স্তর হল অ্যাসথেনোস্ফিয়ার।
৩. পাত কাকে বলে?
উঃ- ভূত্বক বা শিলামণ্ডল কতকগুলি খণ্ডে বিভক্ত; যেগুলি অ্যাসথেনোস্ফিয়ারের ওপর ভাসমান ও চলনশীল অবস্থায় রয়েছে। এই খণ্ডগুলিকে পাত বা Plate বলে।
৪. পর্বত কাকে বলে?
উঃ- সাধারণত ৯০০ মিটারের বেশি উঁচু, অনেকদূর বিস্তৃত, শিলা দ্বারা গঠিত ভূমিরূপই হল পর্বত।
৫. অগ্ন্যুৎপাত কাকে বলে?
উঃ- যে প্রক্রিয়ায় ভূ-অভ্যন্তরের উত্তপ্ত কঠিন, তরল ও গ্যাসীয় পদার্থ ভূত্বকের দূর্বল স্থান দিয়ে ওপরে উঠে ভূপৃষ্ঠে লাভারূপে বেরিয়ে আসে, তাকে অগ্ন্যুৎপাত বলে।
৬. আগ্নেয়গিরি কাকে বলে?
উঃ- আগ্নেয়গিরি হল ভূ-অভ্যন্তরীণ পদার্থ দিয়ে গঠিত ভূপৃষ্ঠের এক ভূমিরূপ। এর আর-এক নাম আগ্নেয় পর্বত।
৭. পর্বতশৃঙ্গ বা পর্বত চূড়া কাকে বলে?
উঃ- পর্বতের উপরের দিকের সরু, সুচালো অংশটি হল পর্বতশৃঙ্গ বা পর্বত চূড়া।
৮. পর্বত উপত্যকা কাকে বলে?
উঃ- দুটি পর্বত অথবা পর্বত চূড়ার মাঝখানের নীচু খাতের মতো অংশটি হল পর্বত উপত্যকা।
৯. পর্বতশ্রেণি বা পর্বতমালা কাকে বলে?
উঃ- অনেকগুলি পর্বতশৃঙ্গ এবং পর্বত উপত্যকা বিরাট অঞ্চলজুড়ে অবস্থান করলে পর্বতশ্রেণি বা পর্বতমালা গঠিত হয়।
১০. পর্বতগ্রন্থি কাকে বলে?
উঃ- অনেকগুলি পর্বতশ্রেণি বিভিন্ন দিক থেকে এক জায়গায় এসে মিলিত হলে, সেই মিলিত অঞ্চলকে পর্বতগ্রন্থি বলা হয়।
১১. পামির মালভূমিকে পৃথিবীর ছাদ বলা হয় কেন?
উঃ- পৃথিবীর সর্বোচ্চ মালভূমি বলে পামিরকে পৃথিবীর ছাদ বলা হয়।
১২. লোয়েস সমভূমি কাকে বলে?
উঃ- মরুভূমি থেকে বায়ুর দ্বারা বয়ে আসা সূক্ষ্ম বালিকণাসমূহ বহুদূরে কোনো নীচু জায়গায় দীর্ঘদিন ধরে সঞ্চিত হয়ে যে সমভূমির সৃষ্টি করে, তাকে বলা হয় লোয়েস সমভূমি।
১৩. অভ্যন্তরীণ বা অন্তর্জাত শক্তি বলতে কী বোঝ?
উঃ- ভূ-অভ্যন্তর থেকে উৎপন্ন যে শক্তিগুলি ভূমিরূপ গঠনে সাহায্য করে, সেই সকল শক্তিকে অভ্যন্তরীণ বা অন্তর্জাত শক্তি বা ভিতরকার শক্তি বলে।
উদাহরণ: ভূ- আলোড়ন।
১৪. বহির্জাত শক্তি বলতে কী বোঝ?
উঃ- যেসব শক্তি ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগে ক্রিয়া (ক্ষয়, বহন ও সঞ্চয়) করে বিভিন্ন প্রকার ভূমিরূপ গঠনে সাহায্য করে, সেইসব শক্তিকে বহির্জাত শক্তি বা বাইরের শক্তি বলে। উদাহরণ: নদী, বায়ু, হিমবাহ, সমুদ্রতরঙ্গ প্রভৃতি হল বহির্জাত শক্তি।
১৫. মহীখাত কী?
উঃ- মহীখাত হল সংকীর্ণ, দীর্ঘ ও অগভীর সমুদ্র, যেখানে পলি সঞ্চয় হয় এবং পরবর্তীকালে ওই সঞ্চিত পলি প্রবল চাপে ভাঁজপ্রাপ্ত হয়ে ভঙ্গিল পর্বত সৃষ্টি করে। উদাহরণ: টেথিস সাগর নামক মহীখাতের সঞ্চিত পলি ভাঁজপ্রাপ্ত হয়ে হিমালয় পর্বত সৃষ্টি হয়েছে।
১৬. উৎপত্তি ও গঠন অনুসারে পর্বত কয়প্রকার ও কি কি?
উঃ- উৎপত্তি ও গঠন অনুসারে পর্বতকে সাধারণত চার ভাগে ভাগ করা হয়। যথা-
ভঙ্গিল পর্বত (Fold Mountain): হিমালয় পর্বতমালা, আল্পস পর্বতমালা, আন্দিজ পর্বতমালা, কানাডীয় রকি পর্বতমালা।
স্তূপ পর্বত (Block-Fault Mountain): ভারতের সাতপুরা পর্বত, বিন্ধ্য পর্বত, ফ্রান্সের ভোজ, জার্মানির ব্ল্যাক ফরেস্ট, কলোরাডোর রকি পর্বতমালা।
আগ্নেয় বা সঞ্চয়জাত পর্বত (Volcanic Mountain): পশ্চিমঘাট পর্বতমালা, ভারতের আন্দামান সংলগ্ন ব্যারেন, জাপানের ফুজিয়ামা, ইতালির ভিসুভিয়াস।
ক্ষয়জাত পর্বত (Residual Mountain): ভারতের রাজস্থানের আরাবল্লী পর্বত, পশ্চিমবঙ্গের শুশুনিয়া, অযোধ্যা, উত্তর আমেরিকার হেনরি, অ্যাপেলেশিয়ান, ইউরাল পর্বতমালা।
১৭. পর্বতের বৈশিষ্ট্য গুলি আলোচনা করো।
উঃ- (ক) পর্বত সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৯০০ মিটার বা তার বেশি উচ্চতা সম্পন্ন হয়।
(খ) পর্বত শিলাময় স্তূপ বিশিষ্ট, যার শৃঙ্গ রয়েছে এবং ঢাল গুলি খাড়া প্রকৃতির।
(গ) পর্বতের বন্ধুরতা অনেক বেশি, অর্থাৎ কোথাও খাড়া ঢাল, অনেক উঁচু চূড়া আবার কোথাও নীচু খাত।
(ঘ) দুটি পর্বতশ্রেণি মাঝখানের একটি উপত্যকা দ্বারা বিভক্ত হয়।
(ঙ) পর্বতে সুউচ্চ শৃঙ্গ লক্ষ করা যায়। যেমন হিমালয় পর্বতের মাউন্ট এভারেস্ট (উচ্চতা, ৮,৮৪৮ মিটার) পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ।
(চ) পর্বতের ঢাল যথেষ্ট খাড়া হয়।
(ছ) কোনো কোনো অঞ্চলে অনেকগুলি পর্বত বিভিন্ন দিকে বিস্তৃত হয়ে পর্বতশ্রেণি গঠন করে।
১৮. ভঙ্গিল পর্বত কাকে বলে?
উঃ- যে সকল পর্বত সমূহ ভূপৃষ্ঠের কোমল পাললিক শিলাস্তর গিরিজনি আলোড়ন প্রক্রিয়ায় আনুভূমিক পার্শ্বচাপে ভাঁজপ্রাপ্ত হয়ে সৃষ্টি হয়, তাকে ভঙ্গিল পর্বত বলে।
উদাঃ হিমালয়, আল্পস, আন্দিজ, রকি।
১৯. ভঙ্গিল পর্বতের উৎপত্তি কীভাবে হয়েছে?
উঃ- বর্তমানে যেখানে হিমালয় পর্বত অবস্থান করছে, সেখানে প্রায় ১০ কোটি বছর আগে টেথিস নামে একটি মহীখাত (Geosyncline) ছিল। এই টেথিস সাগরের উত্তরে ছিল 'আঙ্গারাল্যান্ড' ও দক্ষিণের ভূখণ্ডের নাম ছিল 'গন্ডোয়ানাল্যান্ড'। বহু বছর ধরে এই ভূখণ্ড থেকে নদীবাহিত ক্ষয়প্রাপ্ত পলি এই মহীখাতটিকে ভরটি করতে থাকে। ক্রমশ পলিস্তারের নিম্নমুখী চাপে খাতের তলদেশ বসতে থাকে এবং দু-পাশের ভূখণ্ডগুলি পরস্পরের দিকে সরে আসতে থাকে। এর ফলে মহীখাতে সঙ্কিত পলিতে ভাঁজ পড়ে ক্রমশ ভঙ্গিল পর্বতের উৎপত্তি হয়। মহীখাত থেকে ভি পর্বতের উৎপত্তি হয় বলে ভঙ্গিল পর্বতের প্রশ্ন অপেক্ষা দৈর্ঘ্য অনেক বেশি হয়।
১৯. স্তুপ পর্বত কাকে বলে?
উঃ- ভূ আলোড়নের ফলে সৃষ্ট ভূপৃষ্ঠের চ্যুতিখন্ড সংলগ্নচ্যুতি খন্ড থেকে মহীভাবক আলোড়নের ফলে উঁচু হয়ে গিয়ে যে উচ্চভূমির সৃষ্টি হয়, সেই উচ্চভূমিকে স্তুপ পর্বত বলে।
২০. স্তুপ পর্বতের উৎপত্তি সম্পর্কে আলোচনা করো।
উঃ- স্তুপ পর্বত এর সৃষ্টি সাধারণত চার ভাগে হয়ে থাকে-
(ক) দুটি সমান্তরাল চ্যুতির দ্বারা বিভক্ত তিনটি চ্যুতি খন্ডের মধ্যে দু’পাশের দুটি খণ্ড একই অবস্থায় রয়ে, কিন্তু মাঝের চ্যুতি খন্ডটি উঠে গিয়ে স্তূপ পর্বতে পরিণত হয়।
(খ) দুপাশের চ্যুতিখন্ড দুটি বসে গেলে মাঝের চ্যুতিখণ্ডটি একই অবস্থায় ও উচ্চতায় থেকে গিয়ে স্তূপ পর্বতে পরিণত হয়।
(গ) মাঝের চ্যুতিখন্ডটি বসে গেলে, দু’পাশের চ্যুতিখন্ড দুটি একই উচ্চতায় থেকে গিয়ে স্তূপ পর্বতে পরিণত হয়।
(ঘ) মধ্যবর্তী চুক্তি খন্ডটি একটি দিকের চ্যুতি বরাবর তির্যকভাবে উঠেও স্তুপ পর্বতে পরিণত হয়।
২১. আগ্নেয় পর্বত কাকে বলে?
উঃ- অগ্ন্যুৎপাতের ফলে ভূগর্ভের উত্তপ্ত গলিত পদার্থ ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগের সঞ্চিত হয়ে যে পর্বতের সৃষ্টি হয়ে থাকে আগ্নেয় পর্বত বলে।
লাভা সঞ্চয়ের মাধ্যমে আগ্নেয় পর্বত গঠিত হয় বলে, একে সঞ্চয়জাত পর্বত বলে।
২২. আগ্নেয় পর্বতের উৎপত্তি সম্পর্কে আলোচনা করো।
উঃ- ভূত্বকের দুর্বল স্থান দিয়ে ভূ-অভ্যন্তরের উত্তপ্ত গঠিত ম্যাগমা বাইরে ভূত্বকের উপর জ্বালামুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে এবং বারে বারে সঞ্চিত হতে হতে পর্বতে রূপ নেয়।
২৩. ক্ষয়জাত পর্বত কাকে বলে?
উঃ- নদী, হিমবাহ, বায়ুপ্রবাহ, বৃষ্টিপাত প্রভৃতি প্রাকৃতিক শক্তির দ্বারা ক্ষয়কার্যের ফলে সৃষ্ট পর্বত কে ক্ষয়জাত পর্বত বলে।
২৪. ক্ষয়জাত পর্বতের উৎপত্তি সম্পর্কে আলোচনা করো।
উঃ- ভঙ্গিল পর্বত, স্তুপ পর্বত, আগ্নেয় পর্বত, সঞ্চয়জাত পর্বত যে কোনো প্রকার পর্বত ক্রমশ ক্ষয়প্রাপ্ত হতে হতে ক্ষয়জাত পর্বতে পরিণত হয় এমনকি ক্ষয়জাত পর্বতও ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং আরো নিচু হয়ে যায়।
২৫. সমভূমি কাকে বলে?
উঃ- স্থলভাগের যেসব বিস্তীর্ণ এলাকা সমুদ্রপৃষ্ঠের চেয়ে সামান্য উঁচু (৩০০ মিটারের কম) এবং সামান্য ঢেউ খেলানো, সেই ভূভাগকে সমভূমি বলে।
২৬. সমভূমি শ্রেণীবিভাগ করো।
উঃ- বিভিন্ন ধরনের সমভূমিগুলি হল—
(ক) পলিগঠিত সমভূমি: সাধারণত নদী দ্বারা বয়ে আসা পলি, বালি কাদা ইত্যাদি নদীর দু - পাশে বা মোহানায় সঞ্চিত হয়ে পলিগঠিত সমভূমি গঠিত হয়।
উদাহরণ: সিন্ধু-গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্রের সমভূমি।
(খ) লাভা গঠিত সমভূমি: ভূগর্ভের উত্তপ্ত তরল পদার্থ ভূপৃষ্ঠের ফাটল বা দুর্বল স্থান দিয়ে বাইরে বেরিয়ে ভূপৃষ্ঠের বিস্তীর্ণ অংশে জমাট বেঁধে লাভা সমভূমি গঠিত হয়।
উদাহরণ: আইসল্যান্ডের সমভূমি।
(গ) লোয়েস সমভূমি: মরু অঞ্চলের অতিসূক্ষ্ম বালুকণা বায়ুর দ্বারা বয়ে গিয়ে অনেক দূরে কোনো নীচু স্থানে দীর্ঘদিন ধরে সঞ্চিত হয়ে লোয়েস সমভূমি গঠন করে।
উদাহরণ: গোবি মরুভূমির লোয়েস দ্বারা চিনের হোয়াংহো নদী অববাহিকায় লোয়েস সমভূমি গড়ে উঠেছে।
২৭. সমভূমির বৈশিষ্ট্য গুলি আলোচনা করো।
উঃ- সমভূমির বৈশিষ্ট্যগুলি হল—
(ক) সমভূমির বেশিরভাগ অংশই সমতল হয়।
(খ) স্থলভাগের তিনপ্রকার ভূমিরূপের মধ্যে সমভূমির আয়তন পার্বত্য অঞ্চলের তুলনায় বেশি।
(গ) পৃথিবীর অধিকাংশ সমভূমি নদী উপত্যকা ও সমুদ্র উপকূলে গড়ে উঠেছে।
(ঘ) সমভূমি ধীরে ধীরে ঢালু হয়ে সমুদ্রের সঙ্গে মিশে যায়।
(ঙ) সমভূমির উচ্চতা সাধারণত সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩০০ মিটারের কম হয়।
(চ) সমভূমিগুলি সাধারণত পলিমাটি দিয়ে গঠিত হওয়ায় যথেষ্ট উর্বর হয়।
২৮. মানব জীবনের সমভূমি প্রভাব আলোচনা করো।
উঃ- মানবজীবনে সমভূমির প্রভাব বা গুরুত্ব অপরিসীম। সমভূমি মানবজীবনকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে, এগুলি হল—
কৃষিকাজের সুবিধা: অধিকাংশ সমভূমি উর্বর পলি দ্বারা গঠিত হওয়ায় কৃষিকাজ অত্যন্ত ভালো হয়।
উন্নত পরিবহণ ব্যবস্থা: ভূমিরূপ সমতল হওয়ায় রেলপথ, সড়কপথ ও জলপথের মাধ্যমে সমভূমি অঞ্চলে উন্নত পরিবহণ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে।
শিল্পের বিকাশ: কৃষিসমৃদ্ধ ও উন্নত পরিবহণ ব্যবস্থার কারণে এখানে বিভিন্ন শ্রমশিল্প ও কৃষিভিত্তিক শিল্পের বিকাশ ঘটেছে।
পানীয় জল ও সেচের জলের সুবিধা: বেশিরভাগ সমভূমির ওপর দিয়ে বড়ো বড়ো নদী প্রবাহিত হওয়ায় পানীয় জল বা সেচের জল পেতে অসুবিধা হয় না। ফলে সমভূমিতে জনবসতি খুব বেশি হয়।
জীবনযাপনের অনুকূল পরিবেশ: সমভূমি জীবনযাপনের পক্ষে অত্যন্ত অনুকূল বলে পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ সমভূমিতে বাস করে।
বসতি নির্মাণ: শিল্প, ব্যাবসাবাণিজ্যের সুবিধার জন্য সমভূমিতে বহু প্রাচীনকাল থেকেই নানা ধরনের শহর, নগর, জনপদ গড়ে উঠেছে।
অন্যান্য গুরুত্ব: সমভূমি অঞ্চলে যেসমস্ত জমিতে চাষবাদ হয় না সেই সমস্ত জমিতে পশুপালন ক্ষেত্র গড়ে তোলা সুবিধাজনক।
২৯. মালভূমি কাকে বলে?
উঃ- সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩০০-৬০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত, চারপাশে খাড়া ঢাল যুক্ত, উপরিভাগ তরঙ্গায়িত এবং সুবিস্তৃত ভূমিকে মালভূমি বলে। স্থলভাগের ৩০% এলাকা হল মালভূমি।
উদাহরণ: (১) ভারতে দাক্ষিণাত্য, ছোটোনাগপুর, মেঘালয়। (২) চিনের তিব্বত (বৃহত্তম), পামির (উচ্চতম), ছয়ডাম। (৩) তুরস্কের আনাতোলিয়া। (৪) ইউকন। (৫) কলম্বিয়া। (৬) ইথিয়োপিয়া। (৭) ফিজেন্ড মালভূমি।
৩০. মালভূমির বৈশিষ্ট্য গুলি আলোচনা করো।
উঃ- (ক) মালভূমি হল একটি বহুদূর বিস্তৃত উচ্চভূমি।
(খ) মালভূমি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সাধারণত ৩০০ থেকে ৬০০ মিটার উচ্চতার মধ্যে অবস্থান করে।
(গ) মালভূমির উপরিভাগ কিছুটা তরঙ্গায়িত বা উঁচু নিচু হয়।
(ঘ) মালভূমির চতুর্দিক খাড়া ঢাল যুক্ত হয়।
(ঙ) মালভূমির উপরিভাগ কিছুটা তরঙ্গায়িত বা প্রায় সমতল এবং চতুর্দিক খাড়া ঢাল বিশিষ্ট বলে একে দেখতে অনেকটা টেবিলের মত হয়। তাই মালভূমিকে 'টেবিলল্যান্ড' বলা হয়।
(চ) মালভূমির উপরিভাগে ছোট ছোট পাহাড় অবস্থান করতে পারে।
(ছ) মালভূমি বয়সে প্রাচীন ও নবীন উভয় ধরনের হতে পারে।
৩১. মালভূমির শ্রেণিবিভাগ আলোচনা করো।
উঃ- উৎপত্তি অনুসারে মালভূমি ৩ টি শ্রেণিতে বিভক্ত— ভূগাঠনিক মালভূমি, ক্ষয়জাত মালভূমি ও সঞ্চয়জাত মালভূমি।
৩২. পর্বতবেষ্টিত মালভূমি কাকে বলে?
উঃ- গিরিজনি আলোড়নের ফলে ভঙ্গিল পার্বত্য অঞ্চলের চারপাশে পর্বত ঘেরা যে সুউচ্চ ও বৃহদাকার মালভূমি সৃষ্টি হয়, তাকে পর্বত বেষ্টিত মালভূমি বলে।
৩৩. পর্বতবেষ্টিত মালভূমির বৈশিষ্ট্য গুলি আলোচনা করো।
উঃ- (ক) পর্বত বেষ্টিত মালভূমি চতুর্দিকে পর্বত দ্বারা বেষ্টিত বা ঘেরা থাকে।
(খ) এই ধরণের মালভূমির উচ্চতা অন্যান্য মালভূমির থেকে বেশি হয়।
(গ) এই ধরণের মালভূমি বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে অবস্থান করে।
(ঘ) এই ধরনের মালভূমি নবীন ভঙ্গিল পর্বত অঞ্চলের সৃষ্টি হয়।
(ঙ) এই ধরনের মালভূমি পাললিক শিলা দ্বারা গঠিত হয় এবং পাললিক শিলা দ্বারা গঠিত হয় বলেই এই মালভূমির শিলাস্তরের জীবাশ্ম থাকতে পারে।
উদাহরণ: এশিয়ায় হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলে লাদাখ, তিব্বত (হিমালয় ও কুয়েনলুন), ছয়ডাম (কুয়েনলুন ও আলতিনভাগ), ইউনান, ইরান (এলবুর্জ ও জাগ্রোস), আনাতোলিয়া (পন্টিক ও টরাস) মালভূমি।
৩৪. লাভা গঠিত মালভূমি কাকে বলে?
উঃ- ভূগর্ভস্থ ম্যাগমা কয়েকবার বিদার অগ্ন্যুৎপাতের মাধ্যমে ভূপৃষ্ঠে নির্গত হয়ে বিস্তৃত অঞ্চলে লাভারূপে সঞ্চিত হয়ে চ্যাপটা শীর্ষদেশযুক্ত যে মালভূমি গড়ে ওঠে, তাকে লাভা মালভূমি বলে। অগ্ন্যুৎপাতের মাধ্যমে লাভা সঞ্চয়ের ফলে এটি গঠিত হওয়ায় একে আগ্নেয় বা সঞ্চয়জাত মালভূমিও বলা হয়। এগুলি খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ হয়।
৩৫. লাভা গঠিত মালভূমির বৈশিষ্ট্য গুলি আলোচনা করো।
উঃ- (ক) লাভা জমাট বেঁধে লাভা মালভূমি সৃষ্টি হয়।
(খ) লাভা মালভূমির উপরিভাগ সমতল টেবিলের মত বা সামান্য চ্যাপ্টা হয়।
(গ) এই জাতীয় মালভূমি ব্যাসল্ট জাতীয় লাভা শিলা দ্বারা গঠিত হয়। তাই এই মালভূমির রং কালো হয়।
(ঘ) একাধিকবার লাভা সঞ্চয়ের দ্বারা সৃষ্টি হয় বলে এই মালভূমির প্রান্তভাগে সিঁড়ির মত ধাপ দেখা যায়।
উদাহরণ: ভারতে ডেকানট্রাপ, মালব মালভূমি।
৩৬. ব্যবচ্ছিন্ন মালভূমি কাকে বলে?
উঃ- প্রাচীন ও সুবিস্তৃত মালভূমি বা উচ্চভূমি দীর্ঘকাল নদনদী দ্বারা ক্ষয়প্রাপ্ত ও বিচ্ছিন্ন হয়ে কঠিন শিলায় গঠিত যে ছোটো মালভূমি সমউচ্চতায় অবস্থান করে, তাকে ব্যবচ্ছিন্ন মালভূমি বলে।
৩৭. ব্যবচ্ছিন্ন মালভূমির বৈশিষ্ট্য গুলি আলোচনা করো।
উঃ- (ক) ব্যবচ্ছিন্ন মালভূমি কঠিন ও প্রাচীন শিলা দ্বারা গঠিত।
(খ) এই ধরনের মালভূমির উচ্চতা অন্যান্য মালভূমির তুলনায় অনেক কম হয়।
(গ) এই ধরনের মালভূমিগুলির প্রায় সমান উচ্চতা বিশিষ্ট।
(ঘ) বিভিন্ন খরস্রোতা নদী দ্বারা এই মালভূমিগুলি পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে।
উদাহরণ: ভারতে বুন্দেলখণ্ড, মালনাদ, হাজারিবাগ, মেঘালয়, পুরুলিয়া মালভূমি।
৩৮. মহাদেশীয় মালভূমি কাকে বলে?
উঃ- ভূত্বকের প্রাচীন অংশগুলি বিচ্ছিন্ন হয়ে সুবিস্তৃত মহাদেশ জুড়ে সুস্থায়ী যে প্রাচীন মালভূমি গড়ে ওঠে, তাকে মহাদেশীয় মালভূমি বলে। এই মালভূমি ঢাল বা বর্মের মতো অত্যন্ত কঠিন ও সুস্থায়ী। তাই একে শিল্ড মালভূমি (Shield Plateaus) -ও বলে।
৩৯. মহাদেশীয় মালভূমির বৈশিষ্ট্য গুলি আলোচনা করো।
উঃ- (ক) ভূ-আলোড়নের প্রভাবে এই ধরনের মালভূমি সৃষ্টি হয়।
(খ) এই ধরনের মালভূমিগুলি প্রাচীন গ্রানাইট ও নিস শিলা দ্বারা গঠিত হয়।
(গ) এই ধরনের মালভূমিগুলির শিলার বয়স ১০০ কোটি বছরেরও বেশী।
(ঘ) প্রাচীন আগ্নেয় ও রূপান্তরিত শিলায় গঠিত বলে এই মালভূমিগুলি খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ।
এই মালভূমিগুলি শিল্ড নামেও পরিচিত।
৪০. জনজীবনে মালভূমির প্রভাব আলোচনা করো।
উঃ- জনজীবনে মালভূমির নানা রকম প্রভাব রয়েছে। এগুলি হল-
(ক) বেশির ভাগ বড়ো বড়ো মালভূমিগুলি সবই প্রায় শুষ্ক অঞ্চলে অবস্থিত। বৃষ্টিপাত কম হওয়ার জন্য এখানকার বিস্তীর্ণ তৃণভূমিতে পশুচারণ করার অনুকূল পরিবেশ পাওয়া যায়।
(খ) বেশিরভাগ মালভূমি অঞ্চলগুলি প্রচুর পরিমাণে খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ। তাই মালভূমিকে খনিজ সম্পদের ভাণ্ডার হিসেবে ধরা হয়।
(গ) মালভূমি অঞ্চলের রুক্ষ মাটি এবং প্রতিকূল জলবায়ু স্বল্প বৃষ্টিপাতের কারণে এখানে খুব কম পরিমাণ চাষবাস করা যায়।
(ঘ) মালভূমি অঞ্চলের নদীগুলি সাধারণত খরস্রোতা হওয়ায় সহজেই জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হয়।
৪১. জনজীবনে সমভূমির প্রভাবগুলি আলোচনা করো।
উঃ- জনজীবনে সমভূমির প্রভাবগুলি হল-
(ক) পৃথিবীর বেশিরভাগ সমভূমি নদ-নদীর পলি সঞ্চয়ের ফলে সৃষ্টি হওয়ায় এই অঞ্চলগুলি পৃথিবীর সবথেকে উর্বর অঞ্চল এবং এখানেই পৃথিবীর অধিকাংশ কৃষিকাজ হয়ে থাকে।
(খ) সমভূমি অঞ্চলগুলিতেই একাধিক নদীকেন্দ্রিক সভ্যতা গড়ে উঠেছিল।
(গ) সমভূমি অঞ্চলগুলি পৃথিবীর অন্যতম জনবহুল অঞ্চল। বেশিরভাগ শহর, নগর ও জনপদগুলি সবই সমভূমি অঞ্চলে অবস্থিত। উর্বর সমভূমির জন্য কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং উন্নতমানের পরিবহণ সবকিছুর সুবিধা পাওয়া যায়।
৪২. জনজীবনে পর্বতের প্রভাব গুলি আলোচনা করো।
উঃ- ভূমিরূপের সঙ্গে মানুষের জীবনের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। যেখানে ভূমির প্রকৃতি যেমন মানুষ সেখানে সেভাবেই মানানসই জীবনযাত্রা গড়ে তোলে। ভূমি মানুষের জীবন, জীবিকা, অর্থনৈতিক কাজকর্ম, মাঙ্গলিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের ধারক ও নিয়ন্ত্রক। মানবজীবনে পর্বতের নানারকম প্রভাব রয়েছে, এগুলি হল- (ক) উঁচু পর্বতের বরফগলা জল থেকে সৃষ্টি হয়েছে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, সিন্ধু প্রভৃতি বহু নদী। এই নদীগুলি থেকে সারা বছর জল পাওয়া যায়।
(খ) জলীয় বাষ্পপূর্ণ বাতাস হিমালয় পর্বতে ধাক্কা খেয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুরূপে ভারতে বৃষ্টিপাত ঘটায়।
(গ) পর্বত বিরাট প্রাচীরের মতো উয় ও শীতল বায়ুপ্রবাহকে আটকায়। শীতকালে সাইবেরিয়া থেকে আসা তীব্র শীতল বাতাসকে বাধা দিয়ে হিমালয় পর্বত ভারতে শীতের তীব্রতা কমিয়ে দেয়।
(ঘ) পার্বত্য অঞ্চলে গড়ে ওঠে নরম কাঠের মূল্যবান বনভূমি, পর্বতের ঢালে গড়ে ওঠা তৃণভূমিতে ভালো পশুচারণ ক্ষেত্র তৈরি হয়। বহু মানুষ এর থেকে জীবিকা অর্জন করেন এবং পর্বতের ঢালে ধাপ কেটে চাষবাসও করেন।
(ঙ) পার্বত্য অঞ্চলের নদীগুলি খরস্রোত হওয়ায় জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের সহায়ক হয়। কিছু কিছু পার্বত্য অঞ্চলে প্রচুর খনিজ পদার্থ পাওয়া যায়।
(চ) পর্বতের শিলা, বোল্ডার এসবই ঘরবাড়ি তৈরির উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
(ছ) পার্বত্য অঞ্চলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ঠান্ডা ও আরামদায়ক আবহাওয়ার জন্য ভালো পর্যটন কেন্দ্র গড়ে ওঠে। যেমন দার্জিলিং, সিমলা, কাশ্মীর, উটি প্রভৃতি অঞ্চল।
এই পোস্টের pdf পেতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন ⤵️
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন for "ভূমিরূপ | সপ্তম শ্রেণীর ভূগোল | চতুর্থ অধ্যায় "