কর্তৃত্ববাদী শাসনববস্থা বলতে কী বোঝ? (Authoritarianism) | কর্তৃত্ববাদের বৈশিষ্ট্য | কর্তৃত্ববাদের সুবিধা বা গুণাবলি | কর্তৃত্ববাদের অসুবিধা বা ত্রুটি।
কর্তৃত্ববাদ এমন এক মতাদর্শ, যেখানে ব্যক্তির স্বাধীন চিন্তা ও কর্মকান্ডের পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব বা কর্তৃপক্ষের প্রতি অন্ধ আনুগত্যকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। চরম ক্ষমতা (Absolute Power)-র উপর নিরঙ্কুশ আধিপত্য করায়ত্ত করা এবং সেই ক্ষমতাকে রক্ষা করাই হল কর্তৃত্ববাদের মূল কথা। রাষ্ট্রের চূড়ান্ত কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা যখন কোনো বিশেষ ব্যক্তি, কয়েকজন ব্যক্তি, এলিট গোষ্ঠী বা কোনো রাজনৈতিক দলের হস্তে কুক্ষিগত থাকে, তখন তাকে কর্তৃত্ববাদ বলে।
এই শাসনব্যবস্থার কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো:
কর্তৃত্ববাদের বৈশিষ্ট্য:
ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ:
শাসনব্যবস্থা কেন্দ্রীভূত থাকে একটি নির্দিষ্ট নেতা, দল বা গোষ্ঠীর হাতে। জনগণের মতামত বা অংশগ্রহণ সীমিত বা অবজ্ঞাকৃত হয়।
ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ:
শাসনব্যবস্থা কেন্দ্রীভূত থাকে একটি নির্দিষ্ট নেতা, দল বা গোষ্ঠীর হাতে। জনগণের মতামত বা অংশগ্রহণ সীমিত বা অবজ্ঞাকৃত হয়।
গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার অভাব:
গণমাধ্যম, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
আইনের শাসনের পরিবর্তে ব্যক্তিগত নিয়ন্ত্রণ:
আইনের পরিবর্তে শাসকের ইচ্ছা ও আদেশকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
রাষ্ট্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি:
জনজীবনের সবকিছুতে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ থাকে, যেমন: অর্থনীতি, শিক্ষা, এবং সংস্কৃতি।
সন্ত্রাস ও দমননীতি:
বিরোধী মত ও কার্যক্রম দমনে সন্ত্রাস, গোপন পুলিশ বা সামরিক বাহিনীর ব্যবহার।
জাতীয়তাবাদের প্রচার:
জাতীয়তাবাদ এবং শাসকের প্রতি অন্ধ আনুগত্য তৈরি করার চেষ্টা করা হয়।
নির্বাচনের স্বচ্ছতার অভাব:
নির্বাচন হলেও তা সাধারণত নিয়ন্ত্রিত হয়, যাতে ক্ষমতাসীন দল বা নেতা জয়ী হয়।
প্রোপাগান্ডার ব্যবহার:
জনগণের মনোভাব নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রোপাগান্ডা প্রচারণা চালানো হয়।
কর্তৃত্ববাদ সাধারণত ব্যক্তিগত স্বাধীনতা হ্রাস করে এবং একটি একচেটিয়া ক্ষমতার কাঠামো তৈরি করে।
কর্তৃত্ববাদের সুবিধা বা গুণাবলি:
দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ:
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জটিলতা বা দীর্ঘসূত্রিতার কারণে যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া দেরি হয়, কর্তৃত্ববাদী শাসনে সেগুলি দ্রুত কার্যকর করা সম্ভব।
স্থিতিশীলতা বজায় রাখা:
ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ এবং বিরোধী মত দমনের কারণে রাজনৈতিক অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা কম হতে পারে।
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন:
কর্তৃত্ববাদী শাসনে একটি সরকার দীর্ঘমেয়াদি নীতি বা প্রকল্প কার্যকর করতে পারে, কারণ ক্ষমতার ধারাবাহিকতা বজায় থাকে।
জরুরি অবস্থায় কার্যকর শাসন:
প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ বা সঙ্কটময় অবস্থায় কর্তৃত্ববাদী শাসন দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে এবং বাস্তবায়ন করতে সক্ষম।
আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ:
কঠোর নিয়ম এবং শৃঙ্খলার কারণে অপরাধ বা বিশৃঙ্খলা দমনের ক্ষেত্রে কিছুটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
জাতীয় ঐক্য গঠন:
জাতীয়তাবাদ এবং শাসকের প্রতি আনুগত্য প্রচারের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে একটি ঐক্যের অনুভূতি তৈরি করা হতে পারে।
সংঘাত এড়ানো:
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাত দেখা দিতে পারে, যা কর্তৃত্ববাদী শাসনে নিয়ন্ত্রিত থাকে।
সম্পদের কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা:
অর্থনৈতিক উন্নয়নে কেন্দ্র থেকে সম্পদের বণ্টন বা ব্যবস্থাপনা দ্রুত এবং কার্যকর হতে পারে।
এই সুবিধাগুলি অনেক সময় দীর্ঘমেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। কর্তৃত্ববাদের কারণে স্বাধীনতা, মানবাধিকার, এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তদ্ব্যতীত, এই সুবিধাগুলি শাসকের স্বার্থে ব্যবহৃত হলে তা সাধারণ জনগণের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
কর্তৃত্ববাদের অসুবিধা বা ত্রুটি:
ব্যক্তিস্বাধীনতার অভাব:
কর্তৃত্ববাদে জনগণের মতপ্রকাশ, মতামত প্রদান এবং জীবনযাপনের স্বাধীনতা সীমিত বা সম্পূর্ণভাবে দমন করা হয়।
মানবাধিকার লঙ্ঘন:
বিরোধীদের দমন, গোপন পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ব্যবহার এবং অবাধ গ্রেফতার বা নিপীড়ন মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রধান উপাদান।
দুর্নীতির সম্ভাবনা:
একক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ার ফলে ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতি সহজতর হয়ে যায়।
সীমিত গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ:
জনগণের মতামত বা নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের সুযোগ থাকে না। এটি সমাজে হতাশা ও বৈষম্যের সৃষ্টি করে।
গণমাধ্যম ও তথ্য নিয়ন্ত্রণ:
স্বাধীন গণমাধ্যমকে দমন করা হয় এবং প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে জনগণের মধ্যে ভুল তথ্য ছড়ানো হয়।
অস্থিরতা সৃষ্টির ঝুঁকি:
দীর্ঘমেয়াদে শাসকের প্রতি জনগণের অসন্তোষ জমা হয়, যা সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্ম দেয়।
সৃজনশীলতার অভাব:
স্বাধীন চিন্তাভাবনা ও মতপ্রকাশের সুযোগ না থাকার কারণে নতুন ধারণা বা উদ্ভাবনের প্রবণতা দমন করা হয়।
অর্থনৈতিক বৈষম্য:
কর্তৃত্ববাদী শাসনে সাধারণত ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর অর্থনৈতিক লাভ নিশ্চিত হয়, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য তৈরি করে।
দীর্ঘমেয়াদে ব্যর্থতা:
একতরফা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলে নীতি বা প্রকল্প প্রায়ই জনগণের প্রয়োজনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয় না, যা দীর্ঘমেয়াদে ব্যর্থতা ডেকে আনে।
সামাজিক দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি:
বিরোধী মত বা গোষ্ঠীকে দমন করার কারণে সমাজে দাঙ্গা বা বিদ্রোহের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
নাগরিক সেবা অবহেলা:
কর্তৃত্ববাদী শাসনে সাধারণ নাগরিক সেবা উন্নয়নের পরিবর্তে শাসকের ক্ষমতা সংরক্ষণের ওপর বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়।
কর্তৃত্ববাদের মূল সমস্যা হলো জনগণের স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচারের অভাব। এই শাসনব্যবস্থা প্রায়ই জনগণের স্বার্থের পরিবর্তে শাসকের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য কাজ করে, যা দীর্ঘমেয়াদে একটি সমাজ বা জাতির জন্য ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন for "কর্তৃত্ববাদী শাসনববস্থা বলতে কী বোঝ? (Authoritarianism) | কর্তৃত্ববাদের বৈশিষ্ট্য | কর্তৃত্ববাদের সুবিধা বা গুণাবলি | কর্তৃত্ববাদের অসুবিধা বা ত্রুটি।"