প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র কাকে বলে? প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের সুবিধা ও অসুবিধা:
যে শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রের সমস্ত নাগরিকরা মিলিত হয়ে দেশের শাসনকার্য পরিচালনা করে, তাকে 'প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র' বলা হয়। প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে সমস্ত নাগরিকরা এক জায়গায় মিলিত হয়ে আইন প্রণয়ন, শাসননীতি নির্ধারণ, আয়-ব্যয় মঞ্জুর, যুদ্ধ ও শান্তি সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বিচারকার্য সম্পাদন করে। সমস্ত নাগরিকই রাষ্ট্রকার্যে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করায় এই শাসনব্যবস্থাকে Participatory Democracy বা অংশগ্রহণকারী গণতন্ত্রও বলা হয়। মূলত ক্ষুদ্রায়তন রাষ্ট্র ছাড়া প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। প্রাচীন রোম ও গ্রিসের ক্ষুদ্র নগররাষ্ট্রগুলিতে এই শাসনব্যবস্থা প্রচলিত ছিল।
প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের গুণ বা সুবিধা:
জনগণই শক্তির প্রয়োগ ও ব্যবহারের অধিকারী: প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের সর্বপ্রধান সুবিধা হল, এই ব্যবস্থায় তত্ত্বগতভাবে সার্বভৌম শক্তির অধিকারী জনসাধারণ বাস্তবে ওই শক্তির প্রয়োগ ও ব্যবহারের অধিকারী। এই ব্যবস্থাকে বিশুদ্ধ গণতন্ত্রও বলা যায়, তার কারণ জনসাধারণের ইচ্ছা ও মতামতের ভিত্তিতেই সমগ্র শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হয়।
প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র সহজ ও সরল: প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক শাসন সহজ ও সরল এবং কম ব্যয়বহুল। এইরূপ গণতন্ত্রে জনগণ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা সহজ, সরল প্রকৃতির হওয়ায় আইন, শাসন এবং বিচার বিভাগের মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখতে পাওয়া যায় না।
নাগরিকদের রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি: প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে সমস্ত প্রাপ্ত বয়স্ক নাগরিকরা শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করে। এর ফলে সে দেশের সমস্যা সম্বন্ধে অবহিত হয় এবং সমাধানের ব্যাপারে একে অপরের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশ নেয়। তাই নাগরিকদের শিক্ষা ও রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধি পায়।
দ্রুত সিদ্ধান্তগ্রহণ: প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে শাসক ও শাসিতের সরাসরি সম্পর্ক থাকার ফলে যে-কোনো বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্তগ্রহণ করা সম্ভব হয়। এর ফলে আলোচ্য বিষয়টিকে অন্য কোনো স্থানে প্রেরণ করতে হয় না। ফলে এইরূপ গণতন্ত্রকে অনেকে জরুরি অবস্থার উপযোগী বলে মনে করেন।
সরকারের স্বৈরাচারিতা রোধ: প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের সকল স্তরে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকে বলে, সরকার জনদরদি ও জনকল্যাণকামী ভূমিকা পালন করে থাকে। এর ফলে সরকারের স্বৈরাচারিতা জনগণের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
ব্যয়সাপেক্ষ: এরূপ শাসনব্যবস্থা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ন্যায় ব্যয়বহুল নয়।
আইন প্রণয়ন পদ্ধতি: প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে আইন প্রণয়ন পদ্ধতিটি অত্যন্ত সহজ ও সরল প্রকৃতির হয়ে থাকে। এরূপ গণতন্ত্রে জনগণ নির্দিষ্ট একটি স্থানে সমবেত হয়ে আইন প্রণয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। ফলে সময়ের অপচয়ও ঘটে না।
জনগণ দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয় : প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে জনগণকে প্রশাসনিক কার্য ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়ে সুযোগ দেওয়ার ফলে তারা নিজেদেরকে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলে মনে করে। জনগণ নিজেদের সম্মান ও মর্যাদার ব্যাপারে সচেতন হয়। এর ফলে গভীর দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদ জন্ম নেয়।
আমলাতন্ত্রের প্রভাবমুক্ত : প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র আমলাতান্ত্রিক প্রভাব থেকে মুক্ত। কারণ এই শাসনব্যবস্থায় জনগণের দ্বারা নির্বাচিত কোনো প্রতিনিধিরা তাদের আমলা বা উচ্চপদস্থ কর্মচারী দ্বারা শাসনকার্য সম্পন্ন করে না। এর ফলে জনগণ সরাসরি প্রশাসনিক কাজে হস্তক্ষেপ করে।
বিপ্লবের আশঙ্কামুক্ত: এইরূপ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনগণ ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করায় তাদের মধ্যে কোনো দীর্ঘকালীন অসন্তোষ দানা বাঁধতে পারে না, ফলে বিপ্লবের আশঙ্কা এখানে থাকে না।
মূল্যায়ন: পরিশেষে বলা যায়, বর্তমান বিশ্বে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র একেবারে অচল, তবুও আধুনিক গণতন্ত্রের আদিরূপ হিসেবে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় না।
প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের দোষ বা অসুবিধা:
প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের কিছু সুবিধা থাকলেও এই শাসনব্যবস্থা পুরোপুরি ত্রুটিমুক্ত নয়। প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের দোষ বা অসুবিধাগুলি হল-
অকার্যকর শাসনব্যবস্থা: বর্তমানে বিশ্বের প্রায় অধিকাংশ রাষ্ট্র বৃহদায়তন ও বিপুল জনসংখ্যাবিশিষ্ট। আর এরূপ শাসনব্যবস্থার সবচেয়ে বড়ো ত্রুটি হল বৃহদায়তন রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থা শুধুমাত্র অকার্যকরই নয়, অকাম্যও বটে। কারণ, একটি বৃহৎ রাষ্ট্রের সকল জনগণ দেশের নানান প্রান্ত থেকে এসে একত্রিতভাবে আইন প্রণয়ন করবে- এই ধারণা নিছকই একটি কল্পনামাত্র।
আইন প্রণয়ন ও নীতি নির্ধারণ অসম্ভব: প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে দেশের সকল যোগ্য নাগরিকগণ মতামত প্রকাশের সমসুযোগ পায়। এর ফলে কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আইন প্রণয়ন বা নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে নানান সমস্যা সৃষ্টির সম্ভবনা থাকে। কারণ এমতাবস্থায় সকলেই নিজেদের অভিমত প্রকাশ করতে আগ্রহী হয়ে পড়ে। ফলে, পরস্পরবিরোধী নানান মতামতগুলির মধ্যে সমন্বয়সাধন করে নীতি নির্ধারণ ও আইন প্রণয়ন অসম্ভব হয়ে পড়ে।
অগণতান্ত্রিক নীতি নির্ধারণ: অনেকে মনে করেন, রাষ্ট্রপরিচালনার ন্যায় জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ কার্যসম্পাদনের জন্য যে রাজনৈতিক জ্ঞান, বিচক্ষণতা ও দূরদৃষ্টিতা থাকা বাঞ্ছনীয়, তা রাষ্ট্রের সকল নাগরিকদের মধ্যে থাকা সম্ভব নয়। ফলে এই ধরনের শাসনব্যবস্থায় জনস্বার্থবিরোধী কার্যাবলি সম্পাদন অগণতান্ত্রিক নীতি প্রণয়ন ইত্যাদি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
স্বৈরতন্ত্রের উন্মেষ: এই ধরনের শাসনব্যবস্থায় যদি নাগরিকদের রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপে ঔদাসীন্যতা দেখা দেয়, তাহলে মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তির হাতে শাসনক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ার সম্ভবনা পরিলক্ষিত হয়। ফলস্বরূপ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা স্বৈরতন্ত্রে রূপান্তরিত হয়।
সাংস্কৃতিক বিকাশের পরিপন্থী: প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রকে সাংস্কৃতিক বিকাশের পরিপত্রী বলে মনে করা হয়। রাষ্ট্রের সকল জনসাধারণই যদি শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করে, তাহলে শিল্প, সাহিত্য, চারুকলা, সংগীত প্রভৃতি দিকগুলি ক্রমাগত অবহেলিত হতে থাকবে। এতে দেশের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ ব্যাহত হবে।
আপতকালীন পরিস্থিতির পক্ষে অনুপোযোগী: প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র আপতকালীন পরিস্থিতির ক্ষেত্রে উপযোগী নয় বলে অনেকে অভিমত পোষণ করেছেন। বহিঃশক্তির আক্রমণ বা আভ্যন্তরীণ যুদ্ধবিগ্রহের পরিস্থিতিতে যদি দ্রুত সিন্ধান্তগ্রহণের প্রয়োজন হয়, তখন জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর ভিত্তি করে ক্রমাগত কালবিলম্ব হয়।
বৈচিত্র্যপূর্ণ ভাষা ও সংস্কৃতি: বহু ভাষাভাষি ও বহু সংস্কৃতিসম্পন্ন জনগণের বৈচিত্র্যপূর্ণতা একই রাষ্ট্রে পরিলক্ষিত হলে, সেই রাষ্ট্রে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র সাফল্যমণ্ডিত হওয়ার সম্ভবনা একেবারেই থাকে না।
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির অনুপস্থিতি: প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির বাস্তব প্রয়োগ কখনোই সম্ভব হয়ে ওঠে না। কারণ এখানে আইন, শাসন ও বিচার বিভাগের কার্যাবলির মধ্যে তেমন কোনো সুস্পষ্ট পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না। ফলে অনেক সময় রাষ্ট্রপরিচালনায় জটিলতারও সৃষ্টি হয়।
শাসনতান্ত্রিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি : প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে শাসনতান্ত্রিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় বলে সমালোচনা করা হয়। কারণ, যখনই সাধারণ মানুষ সরকারি কার্যাবলিতে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেয়, তখনই তারা পরস্পর পরস্পরের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়-এই ধারণার বশবর্তী হয়ে সিদ্ধান্তগ্রহণ করতে যায় এবং যার ফল বিপথগামী হয়। তবে একথা সত্য যে, সুষ্ঠুভাবে শাসনকার্য পরিচালনার জন্য দেশের প্রতি যে মমত্ববোধ, কর্তব্যপরায়ণতা, সুশিক্ষিত বিচারবোধ, দেশপ্রেম প্রয়োজন তা কখনোই সকলের মধ্যে উপস্থিত থাকে না। ফলে এরূপ গণতন্ত্র বাস্তবে ব্যর্থ হয়।
অনুপযুক্ত শাসনব্যবস্থা: বর্তমানে আধুনিক জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রের বহুমুখী কার্যকলাপের পরিপ্রেক্ষিতে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র কখনোই উপযুক্ত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা নয়।
জনগণের আবেগ দ্বারা পরিচালিত শাসনব্যবস্থা: সর্বোপরি বলা যায় যে, প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আইন ও শাসনকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে জনগণ অনেকসময় উত্তেজনা বা ভাবাবেগের দ্বারা পরিচালিত হয়। এরূপ পরিস্থিতিতে আইন প্রণয়ন বা শাসনকার্য পরিচালনা করলে, দেশের কল্যাণের পরিবর্তে অকল্যাণ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকে।
মূল্যায়ন: উপরোক্ত আলোচনায় প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের অসুবিধা বা ত্রুটিগুলি উল্লেখ করা হলেও প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের সাফল্য প্রমাণ করে দেয় যে, এই শাসনব্যবস্থা স্বৈরতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের মধ্যযুগীয় একচ্ছত্র আধিপত্য থেকে জনগণকে মুক্তি দিয়ে স্বাধীনতার দ্বারলগ্নে পৌঁছে দিয়েছে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন for "প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র কাকে বলে? প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের সুবিধা ও অসুবিধা:"